পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি aQや মধ্যে কিছুই থাকে না, কেবল দুবুদ্ধি আছে। বরঞ্চ নিজের মাথা ভাঙা ভালো, কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না ।” পথিকদ্বয় শশব্যস্ত ও অপ্রতিভ হইয়া ঠাকুরকে প্ৰণাম করিল। বিন্ধন কহিলেন, “বাপু, তোমরা যে কথা বলছিলে সে কথাগুলো ভালো নয় ।” পথিকদ্বয় কহিল, “ যে, আজ্ঞে ঠাকুর, আর আমন কথা বলব না।” পুরোহিত-ঠাকুরকে পথে ছেলেরা ঘিরিল । তিনি কহিলেন, “আজ বিকালে আমার ওখানে যাস, আমি গল্প শোনাব।” আনন্দে ছেলেরা লাফালাফি চেঁচামেচি বাধাইয়া দিল । বিম্বন ঠাকুর এক-একদিন অপরাহুে রাজ্যের ছেলে জড়ো করিয়া তাহাদিগকে সহজ ভাষায় রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক গল্প শুনাইতেন । মাঝে মাঝে দুই-একটি নীরস কথাও যথাসাধ্য রসসিক্ত করিয়া বলিবার চেষ্টা করিতেন, কিন্তু যখন দেখিতেন ছেলেদের মধ্যে হাই তোলা সংক্রামক হইয়া উঠিতেছে তখন তাহাদের মন্দিরের বাগানের মধ্যে ছাড়িয়া দিতেন । সেখানে ফলের গাছ অসংখ্য আছে । ছেলেগুলো আকাশভেদী চীৎকারশব্দে বানরের মতো ডালে ডালে লুটপাট বাধাইয়া দিত— বিন্ধন আমোদ দেখিতেন । বিন্ধন কোন দেশী লোক কেহ জানে না। ব্ৰাহ্মণ, কিন্তু উপবীত ত্যাগ করিয়াছেন। বলিদান প্রভৃতি বন্ধ করিয়া একপ্রকার নূতন অনুষ্ঠানে দেবীর পূজা করিয়া থাকেন— প্রথম প্রথম তাহাতে লোকেরা সন্দেহ ও আপত্তি প্ৰকাশ করিয়াছিল, কিন্তু এখন সমস্ত সহিয়া গিয়াছে। বিশেষত বিন্ধনের কথায় সকলে বশ । বিন্ধন সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়া সকলের সঙ্গে আলাপ করেন, সকলের সংবাদ লন, এবং রোগীকে যাহা ঔষধ দেন তাহা আশ্চর্য খাটিয়া যায় । বিপদে আপদে সকলেই তাহার পরামর্শমতে কাজ করে- তিনি মধ্যবর্তী হইয়া কাহারও বিবাদ মিটাইয়া দিলে বা কিছুর মীমাংসা করিয়া দিলে তাহার উপরে আর কেহ কথা কহে না । ত্রিংশ পরিচ্ছেদ এই বৎসরে ত্রিপুরায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিল। উত্তর হইতে সহসা পালে পালে ইদুর ত্রিপুরার শস্যক্ষেত্রে আসিয়া পড়িল । শস্য সমস্ত নষ্ট করিয়া ফেলিল, এমন-কি, কৃষকের ঘরে শস্য যত৷-কিছু সঞ্চিত ছিল তাহাও অধিকাংশ খাইয়া ফেলিল- রাজ্যে হাহাকার পড়িয়া গেল । দেখিতে দেখিতে দুৰ্ভিক্ষ উপস্থিত হইল। বন হইতে ফল মূল আহরণ করিয়া লোকে প্রাণধারণ করিতে লাগিল। বনের অভাব নাই, এবং বনে নানাপ্রকার আহার্য উদ্ভিজ্জ ও আছে। মৃগয়ালব্ধ মাংস বাজারে মহার্ঘ মূল্যে বিক্রয় হইতে লাগিল । লোকে বুনো মহিষ, হরিণ, খরগোশ, সজারু, কাঠবিড়ালি, বরা, বড়ো বড়ো স্থলকচ্ছপ শিকার করিয়া খাইতে লাগিল- হাতি পাইলে হাতিও খায়- অজগর সাপ খাইতে লাগিল- বনে আহার্য পাখির অভাব নাই— গাছের কোটরের মধ্যে মৌচাক ও মধু পাওয়া যায়স্থানে স্থানে নদীর জল বাধিয়া তাহাতে মাদক লতা ফেলিয়া দিলে মাছেরা অবশ হইয়া ভাসিয়া উঠে, সেই সকল মাছ ধরিয়া লোকেরা খাইতে লাগিল এবং শুকাইয়া সঞ্চয় করিল । আহার এখনো কোনােক্রমে চলিয়া যাইতেছে বটে, কিন্তু অত্যন্ত বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল। স্থানে স্থানে চুরি ডাকাতি আরম্ভ হইল, প্ৰজারা বিদ্রোহের লক্ষণ প্ৰকাশ করিল। তাহারা বলিতে লাগিল, “মায়ের বলি বন্ধ করাতে মায়ের অভিশাপে এই সকল দুর্ঘটনা ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছে।” বিন্ধন ঠাকুর সে কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন । তিনি উপহাসচ্ছলে কহিলেন, কৈলাসে কার্তিক-গণেশের মধ্যে ভ্ৰাতৃবিচ্ছেদ ঘটিয়াছে, কার্তিকের ময়ূরের নামে গণেশের ইদুরগুলো ত্রিপুরার ত্রিপুরেশ্বরীর কাছে নালিশ করিতে আসিয়াছে।” প্রজারা এ কথা নিতান্ত উপহাসের ভাবে গ্ৰহণ করিল না। তাহারা দেখিল, বিন্ধন ঠাকুরের কথামত ইদুরের স্রোত যেমন দ্রুতবেগে আসিল তেমনি দ্রুতবেগে সমস্ত শস্য নষ্ট করিয়া কোথায় অন্তর্ধান করিল- তিন দিনের মধ্যে তাহাদের আর চিহ্নমাত্র রহিল না। বিন্ধন ঠাকুরের অগাধ জ্ঞানের সম্বন্ধে কাহারও সন্দেহ রহিল না । কৈলাসে S8 br