পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ( 8 রবীন্দ্র রচনাবলী পথে ঘাটে সেই গান প্রচলিত হইল । কিন্তু রাজার প্রতি বিদ্বেষভাব ভালো করিয়া ঘুচিল না । বিন্ধন ঠাকুরের পরামর্শমতে গোবিন্দমাণিক্য দুৰ্ভিক্ষাগ্ৰস্ত প্রজাদের এক বৎসরের খাজনা মাপ করিলেন। তাহার কতকটা ফুল হইল। কিন্তু তবুও অনেকে মায়ের অভিশাপ এড়াইবার জন্য চট্টগ্রামে পার্বত্য প্রদেশে পলায়ন করিল । এমন-কি, রাজার মনে সন্দেহের উদয় হইতে লাগিল । তিনি বিন্ধনকে ডাকিয়া কহিলেন, “ঠাকুর, রাজার পাপেই প্ৰজা কষ্ট পায় । আমি কি মায়ের বলি বন্ধ করিয়া পাপ করিয়াছি ? তাহারই কি এই শাস্তি ?” বিন্ধন সমস্ত কথা একেবারে উড়াইয়া দিলেন । তিনি কহিলেন, “মায়ের কাছে যখন হাজার নরবলি হইত, তখন আপনার অধিক প্রজাহানি হইয়াছে, না। এই দুর্ভিক্ষে হইয়াছে ?” রাজা নিরুত্তর হইয়া রহিলেন। কিন্তু তাহার মনের মধ্য হইতে সংশয় সম্পূর্ণ দূর হইল না। প্রজার তাহার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছে, তাহার প্রতি সন্দেহ প্ৰকাশ করিতেছে, ইহাতে র্তাহার হৃদয়ে আঘাত বুঝিতে পারি না ।” বিম্বন কহিলেন, “অধিক বুঝিবার আবশ্যক কী । কেন কতকগুলো ইদুর আসিয়া শস্য খাইয়া গেল তাহা নাই বুঝিলাম। আমি অন্যায় করিব না, আমি সকলের হিত করিব, এইটুকু স্পষ্ট বুঝিলেই হইল । তার পাবে বিধাতার কাজ বিধাতা করিবেন, তিনি আমাদের হিসাব দিতে আসিবেন না ।” রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, তুমি গৃহে গৃহে ফিরিয়া অবিশ্রাম কাজ করিতেছ, পৃথিবীর যতটুকু হিত করিতেছ ততটুকুই তোমার পুরস্কার হইতেছে, এই আনন্দে তোমার সমস্ত সংশয় চলিয়া যায়। আমি কেবল দিনরাত্রি একটা মুকুট মাথায় করিয়া সিংহাসনের উপরে চড়িয়া বসিয়া আছি, কেবল । কতকগুলো চিন্তা ঘাড়ে করিয়া আছি- তোমার কাজ দেখিলে আমার লোভ হয় ।” বিশ্বন কহিলেন, “মহারাজ, আমি তোমারই তো এক অংশ । তুমি ঐ সিংহাসনে বসিয়া না থাকিলে আমি কি কাজ করিতে পারিতাম ! তোমাতে আমাতে মিলিয়া আমরা উভয়ে সম্পূর্ণ হইয়াছি।” এই বলিয়া বিশ্বন বিদায় গ্রহণ করিলেন, রাজা মুকুট মাথায় করিয়া ভাবিতে লাগিলেন । মনে মনে কহিলেন, “আমার কাজ যথেষ্ট রহিয়াছে, আমি তাহার কিছুই করি না । আমি কেবল আমার চিন্তা লইয়াই নিশ্চিন্ত রহিয়াছি । সেইজন্যই আমি প্রজাদের বিশ্বাস আকর্ষণ করিতে পারি না । রাজ্যশাসনের আমি যোগ্য নাই ।” একত্রিংশ পরিচ্ছেদ মোগল সৈন্যের কর্তী হইয়া নক্ষত্ররায় পথের মধ্যে তেঁতুলে-নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে বিশ্রাম করিতেছিলেন । প্ৰভাতে রঘুপতি আসিয়া কহিলেন, “যাত্ৰা করিতে হইবে মহারাজ, প্ৰস্তুত হােন ।” সহসা রঘুপতির মুখে মহারাজ শব্দ অত্যন্ত মিষ্ট শুনাইল । নক্ষত্ররায় উল্লসিত হইয়া উঠিলেন । তিনি কল্পনায় পৃথিবীসুদ্ধ লোকের মুখ হইতে মহারাজ সম্ভাষণ শুনিতে লাগিলেন। তিনি মনে মনে ত্রিপুরার উচ্চ সিংহাসনে চড়িয়া সভা উজ্জ্বল করিয়া বসিলেন । মনের আনন্দে বলিলেন, “ঠাকুর, আপনাকে কখনোই ছাড়া হইবে না । আপনাকে সভায় থাকিতে হইবে । আপনি কী চান সেইটে আমাকে বলুন ।” । নক্ষত্ররায় মনে মনে রঘুপতিকে তৎক্ষণাৎ বৃহৎ একখণ্ড জায়গির অবলীলাক্রমে দান করিয়া ফেলিলেন । রঘুপতি কহিলেন, “আমি কিছু চাহি না ।” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “সে কী কথা ! তা হইবে না ঠাকুর । কিছু লইতেই হইবে। কয়লােসর পরগনা