পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রঘুপতির অজ্ঞাতসারে নক্ষত্ররায়ের নিকটে কোনাে লোক আসা নিষেধ ছিল,তথাপি সন্ন্যাসীবেশধারী বিম্বনকে কেহই বাধা দিল না । বিম্বন নক্ষত্ররায়কে গিয়া কহিলেন, “মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য আপনাকে স্মরণ করিয়া এই পত্র সে পত্র খুলিতে র্তাহার লজ্জা ও ভয় হইতে লাগিল। যতক্ষণ রঘুপতি গােবিন্দমাণিক্য ও তাহার মধ্যে আড়াল করিয়া দাঁড়ায় ততক্ষণ নক্ষত্ররায় বেশ নিশ্চিন্ত থাকেন। তিনি কোনােমতেই গােবিন্দমাণিক্যকে যেন দেখিতে চান না। গােবিন্দমাণিক্যের এই ত একেবারে নক্ষত্ররায়ের সম্মুখে আসিয়া দাড়াইতেতে নক্ষত্ররায় কেমন যেন সংকুচিত হইয়া পড়িলেন, এবং মনে মনে ঈষৎ বিরক্ত হইলেন। ইচ্ছা হইতে লাগিল। রঘুপতি যদি উপস্থিত থাকিতেন এবং এই দূতকে তাহার কাছে আসিতে না দিতেন । মনের মধ্যে নানা ইতস্তত করিয়া পত্র খুললেন । তাহার মধ্যে কিছুমাত্র ভৎসনা ছিল না । গােবিন্দমাণিক্য র্তাহাকে লজ্জা দিয়া একটি কথাও বলেন নাই। ভাইয়ের প্রতি লেশমাত্র অভিমান প্রকাশ করেন নাই। নক্ষত্ররায় যে সৈন্যসামন্ত লইয়া তাহাকে আক্রমণ করিতে আসিয়াছেন, সে কথার উল্লেখ মাত্র করেন নাই। উভয়ের মধ্যে পূর্বে যেমন ভাব ছিল, এখনাে অবিকল যেন সেই ভাবই আছে। অথচ সমস্ত পত্রের মধ্যে একটি সুগভীর স্নেহ ও বিষাদ প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে— তাহা কোনো স্পষ্ট কথায় ব্যক্ত হয় নাই বলিয়া নক্ষত্ররায়ের হৃদয়ে অধিক আঘাত লাগিল । চিঠি পড়িতে পড়িতে অল্পে অল্পে তাহার মুখভাবের পরিবর্তন হইতে লাগিল। হৃদয়ের পাষাণ আবরণ দেখিতে দেখিতে ফাটিয়া গেল। চিঠি তাহার কম্পমান হাতে কঁাপিতে লাগিল । সে চিঠি লইয়া কিয়ৎক্ষণ মাথায় ধারণ করিয়া রাখিলেন। সে চিঠির মধ্যে ভ্রাতার যে আশীর্বাদ ছিল তাহা যেন শীতল নিৰ্ব্বরের মতাে তাহার তপ্ত হৃদয়ে ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত স্থির হইয়া সুদূর পশ্চিমে সন্ধ্যারাগরক্ত শ্যামল বনভূমির দিকে অনিমেষ নেত্ৰে চাহিয়া রহিলেন । চারি দিকে নিস্তব্ধ সন্ধ্যা অতলস্পর্শ শব্দহীন শান্ত সমুদ্রের মতো জাগিয়া রহিল। ক্রমে তাহার চক্ষে জল দেখা দিল, দ্রুতবেগে অশ্রু পডিতে লাগিল । সহসা লজ্জায় ও অনুতাপে নক্ষত্ররায় দুই হাতে মুখ প্রচ্ছন্ন করিয়া ধরিলেন । কাদিয়া বলিলেন, “আমি এ রাজ্য চাই না । দাদা, আমার সমস্ত অপরাধ মার্জনা করিয়া আমাকে তোমার পদতলে স্থান দাও, আমাকে তোমার কাছে রাখিয়া দাও, আমাকে দূরে তাড়াইয়া দিয়ে না।” । বিন্ধন একটি কথাও বলিলেন না— আদ্ৰ হৃদয়ে চুপ করিয়া বসিয়া দেখিতে লাগিলেন । অবশেষে নক্ষত্ররায় যখন প্রশান্ত হইলেন, তখন বিন্ধন কহিলেন, “যুবরাজ, আপনার পথ চাহিয়া গোবিন্দমাণিক্য বসিয়া আছেন, আর বিলম্ব করিবেন না।” নক্ষত্ররায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাকে কি তিনি মাপ করিবেন ?” বিন্ধন কহিলেন, “তিনি যুবরাজের প্রতি কিছুমাত্র রাগ করেন নাই । অধিক রাত্রি হইলে পথে কষ্ট হইবে । শীঘ্র একটি অশ্ব লউন । পর্বতের নীচে মহারাজের লোক অপেক্ষা করিয়া আছে।”