পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি ۹ اوما( রাজা কহিলেন, “তবে তােমাকে সমস্ত বলি। আমি ধ্রুবকে সঙ্গে করিয়া বনে যাইব । ঠাকুর, আমার জীবন অত্যন্ত অসম্পূর্ণ রহিয়া গিয়াছে। যাহা মনে করিয়াছিলাম তাহার কিছুই করিতে পারি নাই— জীবনের যতখানি চলিয়া গেছে তাহা ফিরিয়া পাইয়া আর নূতন করিয়া গড়িতে পারিব না— আমার মনে হইতেছে, ঠাকুর, অদৃষ্ট যেন আমাদিগকে তীরের মতো নিক্ষেপ করিয়াছে, লক্ষ্য হইতে যদি একবার একটু বাকিয়া গিয়া থাকি, তবে আর যেন সহস্ৰ চেষ্টায় লক্ষ্যের মুখে ফিরিতে পারি না। জীবনের আরম্ভ-সময়ে আমি সেই যে বাকিয়া গিয়াছি, জীবনের শেষকালে আমি আর লক্ষ্য খুঁজিয়া পাইতেছি না। যাহা মনে করি তাহা আর হয় না। যে সময়ে জাগিলে আত্মরক্ষা করিতে পারিতাম সে সময়ে জাগি নাই, যে সময়ে ডুবিয়াছি তখন চৈতন্য হইয়াছে। সমুদ্রে পড়িলে লোকে যেভাবে কাষ্ঠখণ্ড অবলম্বন করে আমি বালক ধ্রুবকে সেইভাবে অবলম্বন করিয়াছি। আমি খুবের মধ্যে আত্মসমাধান করিয়া ধুবের মধ্যে পুনর্জন্ম লাভ করিব । আমি প্রথম হইতে ধ্রুবকে মানুষ করিয়া গড়িয়া তুলিব । ধ্ৰুবের সহিত তিলে তিলে আমিই বাড়িতে থাকিব । আমার মানবজন্ম সম্পূৰ্ণ করিব । ঠাকুর, আমি মানুষের মতো নাই, আমি রাজা হইয়া কী করিব !” শেষ কথাটা রাজা অত্যন্ত আবেগের সহিত উচ্চারণ করিলেন— শুনিয়া ধ্রুব রাজার হাটুর উপর তাহার মাথা ঘষিয়া ঘষিয়া কহিল, “আমি আজ ।” বিন্ধন হাসিয়া ধ্রুবকে কোলে তুলিয়া লইলেন। অনেকক্ষণ তাহাব মুখের দিকে চাহিয়া অবশেষে রাজাকে কহিলেন, “বনে কি কখনো মানুষ গড়া যায় ? বনে কেবল একটা উদ্ভিদ পালন করিয়া তোলা যাইতে পারে । মানুষ মনুষ্যসমাজেই গঠিত হয় ।” রাজা কহিলেন, “আমি নিতান্তই বনবাসী হইব না, মনুষ্যসমাজ হইতে কিঞ্চিৎ দূরে থাকিব মাত্র, অথচ সমাজের সহিত সমস্ত যোগ বিচ্ছিন্ন করিব না । এ কেবল দিনকতকের জন্য ।” এ দিকে নক্ষত্ররায় সৈন্য-সমেত রাজধানীর নিকটবতী হইলেন । প্রজাদের ধনধান্য লুণ্ঠিত হইতে লাগিল । প্ৰজারা কেবল গোবিন্দমাণিক্যাকেই অভিশাপ দিতে লাগিল । তাহারা কহিল, “এ সমস্তই কেবল রাজার পাপে ঘটিতেছে।” রাজা একবার রঘুপতির সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিলেন । রঘুপতি উপস্থিত হইলে তঁহাকে কহিলেন, “আর কেন প্ৰজাদিগকে কষ্ট দিতেছ ? আমি নক্ষত্ররায়কে রাজ্য ছাডিয়া দিয়া চলিয়া যাইতেছি । তোমার মোগল-সৈন্যদের বিদায় করিয়া দাও ।” রঘুপতি কহিলেন, “যে আজ্ঞা, আপনি বিদায় হইলেই আমি মোগল-সৈন্যদের বিদায় করিয়া দিবত্রিপুরা লুষ্ঠিত হয়। ইহা আমার ইচ্ছা নহে ।” রাজা সেইদিনই রাজ্য ছাড়িয়া যাত্রার উদযোগ করিলেন, তাহার রাজবেশ ত্যাগ করিলেন, গেরুয়া বসন পরিলেন । নক্ষত্ররায়কে রাজার সমস্ত কর্তব্য স্মরণ করাইয়া এক দীর্ঘ আশীর্বাব্দ-পত্ৰ লিখিলেন । অবশেষে রাজা ধ্রুবকে কোলে তুলিয়া বলিলেন, “ধুব, আমার সঙ্গে বনে যাবে বাছা ?” ধ্রুব তৎক্ষণাৎ রাজার গলা জড়াইয়া কহিল, “যাব ।” এমন সময়ে রাজার সহসা মনে হইল ধ্রুবকে সঙ্গে লইয়া যাইতে হইলে তাহার খুড়া কেদারেশ্বরের ধ্রুবকে আমার সঙ্গে লইয়া যাই ।” এইজন্যই বোধ করি রাজার কখনো মনে হয় নাই যে, ধ্রুবকে সঙ্গে লইয়া গেলে কেদারেশ্বরের কোনো আপত্তি হইতে পারে । রাজার কথা শুনিয়া কেদারেশ্বর কহিল, “সে আমি পারিব না মহারাজ ।” শুনিয়া রাজার চমক ভাঙিয়া গেল । সহসা তাহার মাথায় বজাঘাত হইল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “কেদারেশ্বর, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো ।” কেদারেশ্বর। না মহারাজ, বনে যাইতে পারিব না।