পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

۹ \\ রবীন্দ্র-রচনাবলী অশ্বারোহণে যাইতেছিলেন, তিনি এই দৃশ্য দেখিয়া রাজার নিকটে ছুটিয়া আসিলেন। কহিলেন, “মহারাজ, এ অপমান তো আর সহ্য হয় না । মহারাজের এই দীন বেশ দেখিয়া ইহারা এরূপ সাহসী হইয়াছে। এই লাউন তরবারি, এই লাউন উষ্ণীষ । মহারাজ কিঞ্চিৎ অপেক্ষা করুন, আমি আমার লোক লইয়া আসিয়া এই বর্বরদিগকে একবার শিক্ষা দিই ।” আমি এখন ইহা অপেক্ষা অনেক গুরুতর অপমান সহ্য করিতে পারি। মুক্ত তরবারি তুলিয়া আমি এ পৃথিবীতে লোকের নিকট হইতে আর সম্মান আদায় করিতে চাহি না । পৃথিবীর সর্বসাধারণে যেরূপ সুসময়ে দুঃসময়ে মান-অপমান সুখ-দুঃখ সহ্য করিয়া থাকে, আমিও জগদীশ্বরের মুখ চাহিয়া সেইরূপ সহ্য করিব । বন্ধুরা বিপক্ষ হইতেছে, আশ্রিতেরা কৃতায় হইতেছে, প্ৰণতেরা দুবিনীত হইয়া উঠিতেছে, এককালে হয়তো ইহা আমার অসহ্য হইত, কিন্তু এখন ইহা সহ্য করিয়াই আমি হৃদয়ের মধ্যে আনন্দ লাভ করিতেছি । যিনি আমার বন্ধু তাহাকে আমি জানিয়াছি। যাও নয়নরায়, তুমি ফিরিয়া যাও, নক্ষত্রকে সমাদরপূর্বক আহবান করিয়া আনো, আমাকে যেমন সম্মান করিতে নক্ষত্ৰকেও তেমনি সম্মান করিয়ো । তোমরা সকলে মিলিয়া সর্বদা নক্ষত্ৰকে সুপথে এবং প্রজার কল্যাণে রক্ষা করো, তোমাদের কাছে আমার বিদায়কালের এই প্রার্থনা | দেখিয়ো, ভ্ৰমেও কখনো যেন আমার কথার উল্লেখ করিয়া বা বলিয়া রাজা তাহার সভাসদের সহিত কোলাকুলি করিয়া অগ্রসর হইলেন, সভাসদ তাহাকে প্ৰণাম করিয়া অশ্রুজল মুছিয়া চলিয়া গেলেন । যখন গোমতীতীরের উচ্চ পাড়ের কাছে গিয়া পৌছিলেন তখন বিন্ধন ঠাকুর অরণ্য হইতে বাহির হইয়া তাহার সম্মুখে আসিয়া অঞ্জলি তুলিয়া কহিলেন, “জয় হউক ৷” রাজা অশ্ব হইতে নামিয়া তাহাকে প্ৰণাম করিলেন । বিম্বন কহিলেন, “আমি তোমার কাছে বিদায় লইতে আসিয়াছি।” রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, তুমি নক্ষত্রের কাছে থাকিয়া তাহাকে সৎপরামর্শ দাও । রাজ্যের হিতসাধন করো ।” বিন্ধন কহিলেন, “না। তুমি যেখানে রাজা নও, সেখানে আমি অকৰ্মণ্য । এখানে থাকিয়া আমি আর কোনো কাজ করিতে পারিব না ।” রাজা কহিলেন, “তবে কোথায় যাইবে ঠাকুর ? আমাকে তবে দয়া করো, তোমাকে পাইলে আমি দুর্বল হৃদয়ে বল পাই ।” বিন্ধন কহিলেন, “কোথায় আমার কাজ আছে আমি তাঁহাই অনুসন্ধান করিতে চলিলাম । আমি কাছে থাকি আর দূরে থাকি তোমার প্রতি আমার প্ৰেম কখনো বিচ্ছিন্ন হইবে না জানিয়ো । কিন্তু বলিয়া দ্বিতীয়বার প্রণাম করিলেন । বিন্ধন এক দিকে চলিয়া গেলেন, রাজা অন্য দিকে চলিয়া ((व् । অষ্টাত্রিংশ পরিচ্ছেদ নক্ষত্ররায় ছত্রমাণিক্য নাম ধারণ করিয়া মহাসমারোহে রাজপদ গ্ৰহণ করিলেন। রাজকোষে অর্থ অধিক ছিল না। প্রজাদের যথাসর্বস্ব হরণ করিয়া প্রতিশ্রুত অর্থ দিয়া মোগল-সৈন্যদের বিদায় করিতে হইল । ঘোরতর দুৰ্ভিক্ষ ও দারিদ্র্য লইয়া ছত্রমাণিক্য রাজত্ব করিতে লাগিলেন। চতুর্দিক হইতে অভিশাপ ও ক্ৰন্দন বর্ষিত হইতে লাগিল । যে আসনে গোবিন্দমাণিক্য বসিতেন, যে শয্যায় গোবিন্দমাণিক্য শয়ন করিতেন, যে-সকল লোক