পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

C\obr রবীন্দ্র-রচনাবলী নিশ্বাস শূন্য গৃহে ধ্বনিত হইয়া উঠিল। ক্রমে অন্ধকারে আর কিছুই দেখা যায় না। একটা টিকটিকি মাঝে মাঝে কেবল টিকটিক শব্দ করিতে লাগিল। মুক্ত দ্বার দিয়া ঘরের মধ্যে শীতের বায়ু প্রবেশ করিতে লাগিল। রঘুপতি সিন্দুকের উপরে বসিয়া কঁাপিতে লাগিলেন । এইরূপে এক মাস এই বিজন মন্দিরে কাটাইলেন, কিন্তু এমন করিয়া আর দিন কাটে না । পৌরোহিত্য ছাড়িতে হইল। রাজসভায় গেলেন। রাজ্যশাসনকার্যে হস্তক্ষেপ করিলেন। দেখিলেন, অবিচার উৎপীড়ন ও বিশৃঙ্খলা ছত্রমাণিক্য নাম ধরিয়া রাজত্ব করিতেছে। তিনি রাজ্যে শৃঙ্খলাস্থাপনের চেষ্টা করিলেন । ছত্রমাণিক্যকে পরামর্শ দিতে গেলেন । ছত্রমাণিক্য চটিয়া উঠিয়া বলিলেন, “ঠাকুর, রাজ্যশাসনকার্যের তুমি কী জানো ? এ-সব বিষয় তুমি কিছু বোঝা না ।” রঘুপতি রাজার প্রতাপ দেখিয়া অবাক হইয়া গেলেন । দেখিলেন, সে নক্ষত্ররায় আর নাই । রঘুপতির সহিত রাজার ক্রমাগত খিটিমিটি বাধিতে লাগিল। ছত্রমাণিক্য মনে করিলেন যে, রঘুপতি কেবলই ভাবিতেছে যে রঘুপতিই তাহাকে রাজা করিয়া দিয়াছে। এইজন্য রঘুপতিকে দেখিলে তাহার অসহ্য বোধ হইত । অবশেষে একদিন স্পষ্ট বলিলেন, “ঠাকুর, তুমি তোমার মন্দিরের কাজ করোগে । রাজসভায় তোমার কোনো প্ৰয়োজন নাই ।” রঘুপতি ছত্রমাণিক্যের প্রতি জ্বলন্ত তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। ছত্রমাণিক্য ঈষৎ অপ্রতিভ হইয়া মুখ ফিরাইয়া চলিয়া গেলেন । উনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ নক্ষত্ররায় যেদিন নগরপ্ৰবেশ করেন কেদারেশ্বর সেইদিনই তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যায়, কিন্তু বহু চেষ্টাতেও সে র্তাহার নজরে পড়িল না । সৈন্যেরা ও প্রহরীরা তাহাকে ঠেলিয়াঠলিয়া, তাড়া দিয়া, নাড়া দিয়া, বিব্রত করিয়া তুলিল । অবশেষে সে প্ৰাণ লইয়া পলাইয়া যায়। গোবিন্দমাণিক্যের আমলে সে রাজভোগে পরম পরিতৃপ্ত হইয়া প্রাসাদে বাস করিত, যুবরাজ নক্ষত্ররায়ের সহিত তাহার বিশেষ প্ৰণয়ও ছিল । কিছুকাল প্রাসাদচ্যুত হইয়া তাহার জীবনধারণ করা দায় হইয়া উঠিয়াছে ; যখন সে রাজার ছায়ায় ছিল তখন সকলে তাহাকে সভয়ে সম্মান করিত, কিন্তু এখন তাহাকে কেহই আর গ্রাহ্য করে না। পূর্বে রাজসভায় কাহারও কিছু প্রয়োজন হইলে তাহাকে হাতে-পায়ে আসিয়া ধরিত, এখন পথ দিয়া চলিবার সময় কেহ তাহার সঙ্গে দুটাে কথা কহিবার অবসর পায় না । ইহার উপরে আবার অন্নকষ্টও হইয়াছে। এমন অবস্থায় প্রাসাদে পুনর্বার প্রবেশ করিতে পারিলে তাহার বিশেষ সুবিধা হয় । সে একদিন অবসরমত কিছু ভেট সংগ্ৰহ করিয়া প্রকাশ্য রাজদরবারে ছত্রমাণিক্যের সহিত দেখা করিতে গেল। পরম পরিতোষ প্রকাশ্যপূর্বক অত্যন্ত পোষ-মানা বিনীত হাস্য হাসিতে হাসিতে রাজার সম্মুখে আসিয়া দাড়াইল । রাজা তাহাকে দেখিয়াই জ্বলিয়া উঠিলেন । বলিলেন, “হাসি কিসের জন্য ! তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা পাইয়াছ ! তুমি একি রহস্য করিতে আসিয়াছ!” অমনি চোপদার জমাদার বরকন্দাজ মন্ত্রী অমাত্য সকলেই হঁহাকার দিয়া উঠিল । তৎক্ষণাৎ কেদারেশ্বরের বিকশিত দন্তপঙক্তির উপর যবনিক পতন হইল । ছত্রমাণিক্য কহিলেন, “তোমার কী বলিবার আছে। শীঘ্ৰ বলিয়া চলিয়া যাও ।” কেদারেশ্বরের কী বলিবার ছিল মনে পড়িল না। অনেক কষ্টে সে মনে মনে যে বক্তৃতাটুকু গড়িয়া তুলিয়াছিল তাহা পেটের মধ্যেই চুরমার হইয়া গেল । অবশেষে রাজা যখন বলিলেন, “তোমার যদি কিছু বলিবার না থাকে তো চলিয়া যাও”, তখন কেদারেশ্বর চটপট একটা যা-হয়-কিছু বলা আবশ্যক বিবেচনা করিল। চোখে মুখে কণ্ঠস্বরে সহসা