পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ N9Հ) প্রচুর পরিমাণে করুণ রস সঞ্চার করিয়া বলিল, “মহারাজ, কি ভুলিয়া গিয়াছেন ?” ਬਜਜਜ ਅੰਸ਼ যে মহারাজের জন্য কাকা কাকা করিয়া কাদিয়া সারা হইতেছে।” ছত্রমাণিক্য কহিলেন, “তােমার আস্পর্ধা তাে কম নয় দেখিতেছি। তােমার ভ্রাতুষ্পপুত্র আমাকে কাকা বলে ? তুমি তাহাকে এই শিক্ষা দিয়াছ !” ছত্রমাণিক্য কহিলেন, “কে আছ হে— ইহাকে আর সেই ছেলেটাকে রাজ্য হইতে দূর করিয়া দাও (डा ।” সহসা স্কন্ধের উপর এতগুলো প্রহরীর হাত আসিয়া পড়িল যে, কেদারেশ্বর তীরের মতো একেবারে বাহিরে ছিটকাইয়া পড়িল । হাত হইতে তাহার ডালি কড়িয়া লইয়া প্রহরীরা তাহা ভাগ করিয়া লইল । ধ্রুবকে লইয়া কেদারেশ্বর ত্রিপুরা পরিত্যাগ করিল। চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ রঘুপতি আবার মন্দিরে ফিরিয়া গেলেন। গিয়া দেখিলেন, কোনো প্ৰেমপূৰ্ণ হৃদয় বস্ত্ৰাদি লইয়া তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া নাই ৷ পাষাণমন্দির দাড়াইয়া আছে, তাহার মধ্যে কোথাও হৃদয়ের লেশমাত্ৰ নাই । তিনি গিয়া গোমতীতীরের শ্বেত সোপানের উপর বসিলেন । সোপানের বাম পার্শ্বে জয়সিংহের স্বহস্তে রোপিত শেফালিকা গাছে অসংখ্য ফুল ফুটিয়াছে। এই ফুলগুলি দেখিয়া জয়সিংহের সুন্দর মুখ, সরল হৃদয়, সরল জীবন এবং অত্যন্ত সহজ বিশুদ্ধ উন্নত ভাব তাহার স্পষ্ট মনে পড়িতে লাগিল । সিংহের ন্যায় সবল তেজস্বী এবং হরিণশিশুর মতো সুকুমার জয়সিংহ রঘুপতির হৃদয়ে সম্পূর্ণ আবির্ভূত হইল, তাহার সমস্ত হৃদয় অধিকার করিয়া লইল । ইতিপূর্বে তিনি আপনাকে জয়সিংহের চেয়ে অনেক বড়ো জ্ঞান করিতেন, এখন জয়সিংহকে তাহার নিজের চেয়ে অনেক বড়ো মনে হইতে লাগিল । তাহার প্রতি জয়সিংহের সেই সরল ভক্তি স্মরণ করিয়া জয়সিংহের প্রতি তাহার অত্যন্ত ভক্তির উদয় হইল, এবং নিজের প্রতি তাহার অভক্তি জন্মিল । জয়সিংহকে যে-সকল অন্যায় তিরস্কার করিয়াছেন তাহা স্মরণ করিয়া তাহার হৃদয় বিদীর্ণ হইল । তিনি মনে মনে কহিলেন, “জয়সিংহের প্রতি ভৎসনার আমি অধিকারী নই। জয়সিংহের সহিত যদি এক মুহূর্তের জন্য একটিবার দেখা হয়, তবে আমি আমার হীনত্ব স্বীকার করিয়া তাহার নিকট একবার মার্জনা প্রার্থনা করিয়া লই ।” জয়সিংহ যখন যাহা যাহা বলিয়াছে করিয়াছে সমস্ত র্তাহার মনে পড়িতে লাগিল ৷ জয়সিংহের সমস্ত-জীবন সংহত ভাবে তাহার মধ্যে বিরাজ করিতে লাগিল । তিনি এইরূপ একটি মহৎ চরিত্রের মধ্যে আত্মবিস্মৃত হইয়া সমস্ত বিবাদ বিদ্বেষ ভুলিয়া গেলেন। চারি দিকে গুরুভার সংসার লঘু হইয়া গিয়া তীহাকে পীড়ন করিতে বিরত হইল । যে নক্ষত্রমাণিক্যকে তিনিই রাজা করিয়া দিয়াছেন সে যে রাজা হইয়া আজ তাহাকেই অপমান করিয়াছে ইহা স্মরণ করিয়া তাহার কিছুমাত্র রোষ জন্মিল না । এই মান-অপমান সমস্তই সামান্য মনে করিয়া তাহার ঈষৎ হাসি আসিল । কেবল তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল জয়সিংহ যাহাতে যথার্থ সন্তুষ্ট হয় এমন একটা-কিছু কাজ করেন । অথচ চতুর্দিকে কাজ কিছুই দেখিতে পাইলেন না— চতুর্দিকে শূন্য হাহাকার করিতেছে। এই বিজন মন্দির ঠাঁহাকে যেন চাপিয়া ধরিল, তাহার যেন নিশ্বাস রোধ করিল। একটা-কিছু বৃহৎ কাজ করিয়া তিনি হৃদয়বেদনা শান্ত করিয়া রাখিবেন, কিন্তু এই সকল নিস্তব্ধ নিরুদ্যম নির্যালয় মন্দিরের দিকে চাহিয়া পিঞ্জীরবদ্ধ পাখির মতো তাহার হৃদয় অধীর হইয়া উঠিল। তিনি উঠিয়া বনের মধ্যে অধীরভাবে পদচারণ করিতে লাগিলেন। মন্দিরের ভিতরকার অলস অচেতন অকৰ্মণ্য জড়প্রতিমাগুলির প্রতি র্তাহার অতিশয় ঘূণার উদয় হইল। হৃদয় যখন বেগে উদবেল হইয়া উঠিয়াছে তখন কতকগুলি নিরুদ্যম স্কুল পাষাণমূর্তির নিরুদ্যম সহচর হইয়া চিরদিন অতিবাহিত করা তাহার নিকটে অত্যন্ত হেয় বলিয়া বোধ হইল। যখন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর হইল, রঘুপতি চকমকি ঠকিয়া একটি প্রদীপ জ্বালাইলেন। দীপহন্তে চতুর্দশ দেবতার S8&