পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

११० রবীন্দ্র-রচনাবলী মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন । গিয়া দেখিলেন, চতুর্দশ দেবতা সমান ভাবেই দাড়াইয়া আছে গ বৎসর আষাঢ়ের কলরাত্রে ক্ষীণ দীপালোকে ভক্তের মৃতদেহের সম্মুখে রক্তপ্রবাহের মধ্যে যেমন বুদ্ধিহীন হৃদয়হীনের মতো দাড়াইয়া ছিল, আজও তেমনি দাড়াইয়া আছে। রঘুপতি চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “মিথ্যা কথা ! সমস্ত মিথ্যা ! হা বৎস জয়সিংহ, তোমাৰ অমূল্য হৃদয়ের রক্ত কাহাকে দিলে! এখানে কোনাে দেবতা নাই, কোনাে দেবতা নাই। পিশাচ রঘুপতি সে রক্ত পান করিয়াছে।” বলিয়া কালীর প্রতিমা রঘুপতি আসন হইতে টানিয়া তুলিয়া লইলেন । মন্দিরের দ্বারে দাড়াইয়। সবলে দূরে নিক্ষেপ করিলেন। অন্ধকারে পাষাণসোপানের উপর দিয়া পাষাণপ্রতিমা শব্দ করিয়া গড়াইতে গড়াইতে গোমতীর জলের মধ্যে পড়িয়া গেল। অজ্ঞােনরাক্ষসী পাষাণ-আকৃতি ধারণ কবিয়া এতদিন রক্তপান করিতেছিল, সে আজ গোমতীগর্ভের সহস্ৰ পাষাণের মধ্যে অদৃশ্য হইল, কিন্তু মানবের কঠিন হৃদয়াসন কিছুতেই পরিত্যাগ করিল না। রঘুপতি দীপ নিবাইয়া দিয়া পথে বাহির হইয় পড়িলেন, সেই রাত্রেই রাজধানী ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন । একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ নোয়াখালির নিজামতপুরে বিন্ধন ঠাকুর কিছুদিন হইতে বাস করিতেছেন । সেখানে ভয়ংকর ফাল্লুন মাসের শেষাশেষি একদিন সমস্ত দিন মেঘ করিয়া থাকে, মাঝে মাঝে অল্প অল্প বৃষ্টিও হয় ; অবশেষে সন্ধ্যার সময় রীতিমত ঝড় আরম্ভ হয়। প্রথমে পূর্বদিক হইতে প্ৰবল বায়ু বহিতে থাকে । রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের সময় উত্তর ও উত্তর-পূর্ব হইতে প্রবল বেগে ঝড় বহিতে লাগিল । অবশেষে মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইয়া ঝড়ের বেগ কমিয়া গেল। এমন সময়ে রব উঠিল— বন্যা আসিতেছে ; চুড়ায় আশ্রয় লইল । অন্ধকার রাত্রি, অবিশ্রাম বৃষ্টি— বন্যার গর্জন ক্রমে নিকটবতী হইল, আতঙ্কে গ্রামের লোকেরা দিশাহারা হইয়া গেল । এমন সময়ে বন্যা আসিয়া উপস্থিত হইল । উপরি-উপরি দুই বার তরঙ্গ আসিল, দ্বিতীয় বারের পরে গ্রামে প্ৰায় আট হাত জল দাড়াইল । পরদিন যখন সূর্য উঠিল এবং জল নামিয়া গেল, তখন দেখা গেল— গ্রামে গৃহ অল্পই অবশিষ্ট আছে, এবং লোক নাই— অন্য গ্রাম হইতে মানুষ-গোরু, মহিষ-ছাগল এবং শৃগাল-কুকুরের মৃতদেহ ভাসিয়া আসিয়াছে । সুপারির গাছগুলা ভাঙিয়া ভাসিয়া গেছে, গুড়ির কিয়দংশ মাত্র অবশিষ্ট আছে। বড়ো বড়ো আম-কঁঠালের গাছ সমূলে উৎপাটিত হইয়া কান্ত হইয়া পড়িয়া আছে। অন্য গ্রামের গৃহের চাল ভাসিয়া আসিয়া ভিত্তির শোকে ইতস্তত উপুড় হইয়া পড়িয়া আছে। অনেকগুলো হাঁড়ি-কলসী বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে । অধিকাংশ কুটিরই বঁাশঝাড় আম কঁঠাল মাদার প্রভৃতি বড়ো বড়ো গাছের দ্বারা আবৃত ছিল, এইজনা অনেকগুলি মানুষ একেবারে ভাসিয়া না গিয়া গাছে আটকাইয়া গিয়াছিল। কেহ বা সমস্ত রাত্রি বন্যাবেগে দোদুল্যমান বঁাশঝাড়ে দুলিয়াছে, কেহ বা মাদারের কণ্টকে ক্ষতবিক্ষত, কেহ বা উৎপাটিত বৃক্ষ-সমেত ভাসিয়া গেছে। জল সরিয়া গেলে জীবিত ব্যক্তিরা নামিয়া আসিয়া মৃতের মধ্যে বিচরণ করিয়া আত্মীয়দিগকে অন্বেষণ করিতে লাগিল। অধিকাংশ মৃতদেহই অপরিচিত এবং ভিন্ন গ্রাম হইতে আগত । কেহই তাহাদিগকে সৎকার করিল না। পালে পালে শকুনি আসিয়া মৃতদেহ ভক্ষণ করিতে লাগিল। শৃগাল-কুকুরের সহিত তাহাদের কোনাে বিবাদ নাই, কারণ শৃগাল-কুকুরও সমস্ত মরিয়া গিয়াছে। বারো ঘর পাঠান গ্রামে বাস করিত ; তাহারা অনেক উচ্চ জমিতে বাস করিত বলিয়া তাহাদের প্রায় কাহারও কোনো ক্ষতি হয় নাই। অবশিষ্ট জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে যাহারা গৃহ পাইল, তাহারা গৃহে আশ্রয় লইল— যাহারা পাইল না, তাহারা আশ্রয়-অন্বেষণে অন্যত্র গেল। যাহারা বিদেশে ছিল তাহারা দেশে ফিরিয়া আসিয়া নূতন গৃহ নির্মাণ করিল। ক্রমে অল্পে অল্পে পুনশ্চ লোকের বসতি