পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ Գ@ লাগিলেন। সন্ধ্যা অতীত হইল, দূরে শৃগাল ডাকিয়া উঠিল । বালক গল্প শুনিতে ভুলিয়া ঘুমাইয়া পড়িল । শুনিতে শুনিতে রোগের কষ্ট পড়িতে লাগিল। রাজা কহিলেন, 'ধ্রুবকে হারাইয়া সকল বালককেই আমার ধ্রুব বলিয়া বোধ হয় ।” বুকুবুন্টু শুনিলেন, পাশের ঘরে ছেলেটি জাগিয়া উঠিয়া তাহার বাপক জিজ্ঞাসা করিতেছে"বাবা, दोऊ ?” বাপ কহিল, “বাশি বাজিতেছে।” ছেলে । বঁশি কেন বাজে ? বাপ । কাল যে পূজা বাপ আমার ! ছেলে । কাল পূজা ? পূজার দিন আমাকে কিছু দেবে না ? বাপ । কী দেব বাবা ? ছেলে । আমাকে একটা রাঙা শাল দেবে না ? বাপ । আমি শাল কোথায় পাব ? আমার যে কিছু নেই, মানিক আমার ! ছেলে । বাবা, তোমার কিছুই নেই বাবা ? বাপ । কিছু নেই বাবা, কেবল তুমি আছ । ভগ্নহৃদয় পিতার গভীর দীর্ঘনিশ্বাস পাশের ঘর হইতে শুনা গেল। ছেলে আর-কিছুই বলিল না। বোধ করি বােপকে জড়াইয়া ধরিয়া আবার ঘুমাইয়া পড়িল । রাত্রি শেষ না হইতে হইতেই গোবিন্দমাণিক্য গৃহস্বামীর নিকট বিদায় না লইয়াই অশ্বারোহণে রামু শহরের অভিমুখে চলিয়া গেলেন । আহার করিলেন না, বিশ্রাম করিলেন না। পথের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র নদী ছিল ; ঘোড়াসুদ্ধ নদী পার হইলেন । প্রখর রৌদ্রের সময় রামুতে গিয়া পৌছিলেন । সেখানে অধিক বিলম্ব করিলেন না। আবার সন্ধ্যার কিছু পূর্বেই যাদবের কুটিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । যাদবকে আড়ালে ডাকিয়া আনিলেন । তাহার ঝুলির মধ্য হইতে একখানি লাল শাল বাহির করিয়া যাদবের হাতে দিয়া কহিলেন, “আজ পূজার দিনে এই শালটি তোমার ছেলেকে দাও।” যাদব কাদিয়া গোবিন্দমাণিক্যের পা জড়াইয়া ধরিল । কহিল, “প্ৰভু, তুমি আনিয়াছ, তুমিই দাও।” রাজা কহিলেন, “না, আমি দিব না, তুমি দাও । আমি দিলে কোনো ফল নাই । আমার নাম করিয়ো না । আমি কেবল তোমার ছেলের মুখে আনন্দের হাসি দেখিয়া চলিয়া যাইব ।” রুগণ বালকের অতি শীর্ণ স্নান মুখ প্ৰফুল্ল দেখিয়া রাজা চলিয়া গেলেন। রাজা বিষগ্ন হইয়া মনে মনে কহিলেন, “আমি কোনো কাজ করিতে পারি না । আমি কেবল কয়টা বৎসর রাজত্বই করিয়াছি, কিছুই শিক্ষা করি নাই। কী করিলে একটি ক্ষুদ্র বালকের রোগের কষ্ট একটু নিবারণ হইবে তাহা জানি না । আমি কেবল অসহায় অকৰ্মণ্য ভাবে শোক করিতেই জানি । বিন্ধন ঠাকুর যদি থাকিতেন তো ইহাদের কিছু উপকার করিয়া যাইতেন । আমি যদি বিন্ধন ঠাকুরের মতো হইতাম ! গােবিন্দমাণিক্য বলিলেন, “আমি আর ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইব না, লোকালয়ের মধ্যে বাস করিয়া কাজ করিতে শিখিব।” রামুর দক্ষিণে রাজাকুলের নিকটে মাগদিগের যে দুৰ্গ আছে, আরাকানরাজের অনুমতি লইয়া গ্রামবাসীদের যতগুলো ছেলেপিলে ছিল, সকলেই দুর্গে গোবিন্দমাণিক্যের নিকটে আসিয়া জুটিল । গোবিন্দমাণিক্য তাহাদিগকে লইয়া একটা বড়ো পাঠশালা খুলিলেন । তিনি তাহাদিগকে পড়াইতেন, তাহাদের সহিত খেলিতেন, তাহাদের বাড়িতে গিয়া তাহাদের সহিত বাস করিতেন, পীড়া হইলে তাহাদিগকে দেখিতে যাইতেন । ছেলেরা সাধারণত যে নিতান্তই স্বৰ্গ হইতে আসিয়াছে এবং তাহারা যে দেবশিশু তাহা নহে, তাহাদের মধ্যে মানব এবং দানব। -ভাবের কিছুমাত্র অপ্রতুল নাই। স্বার্থপরতা ক্ৰোধ লোভ দ্বেষ হিংসা তাহাদের মধ্যে সম্পূর্ণ বলবান, তাহার উপরে আবার বাড়িতে পিতামাতার নিকট হইতেও সকল সময়ে ভালো শিক্ষা পায় যে তাহা নহে। এইজন্য মগের দুর্গে মগের রাজত্ব