পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ Գ Տ একপ্রকার জ্বালাবিহীন বিমল জ্যোতি প্রকাশ পায়, ফকিরের মুখে তাহা দেখিতে পাইলেন না । ফকির সর্বদা-সতর্ক সচকিত । তাহার হৃদয়ের তৃষিত বাসনা-সকল তাহার দুই জ্বলন্ত নেত্ৰ হইতে যেন অগ্নি পান করিতেছে। অধীর হিংসা তাহার দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠাধর এবং দৃঢ়লগ্ন দন্তের মধ্যে বিফলে প্রতিহত হইয়া পুনরায় যেন হৃদয়ের অন্ধকার গহবরে প্রবেশ করিয়া আপনাকে আপনি দংশন করিতেছে। সঙ্গে তিনজন বালক, তাহাদের অত্যন্ত সুকুমার সুন্দর শ্ৰান্ত ক্লিষ্ট দেহ ও একপ্রকার গর্বিত সংকোচ দেখিয়া মনে হইল যেন তাহারা আজন্মকাল অতি সযত্নে সম্মানের শিকার উপরে তোলা ছিল, এই প্রথম তাহাদের ভূমিতলে পদার্পণ । চলিতে গেলে যে চরণের অঙ্গুলিতে ধূলি লাগে ইহা যেন পূর্বে তাহাদের প্রত্যক্ষ জানা ছিল না । পৃথিবীর এই ধূলিময় মলিন দারিদ্র্যে প্রতিপদে যেন পৃথিবীর উপরে তাহাদের ঘূণা জন্মিতেছে, মছলন্দ ও মাটির প্রভেদ দেখিয়া প্রতিপদে তাহারা যেন পৃথিবীকে তিরস্কার করিতেছে। পৃথিবী যেন তাহাদেরই প্রতি বিশেষ আড়ি করিয়া আপনার বড়ো মছলন্দাখানা গুটািইয়া রাখিয়াছে । সকলেই যেন তাহাদের নিকটে অপরাধ করিতেছে । দরিদ্র যে ভিক্ষা করিবার জন্য তাহার মলিন বসন লইয়া তাহাদের কাছে ঘেঁষিতে সাহস করিতেছে। এ কেবল তাহার স্পর্ধা ; ঘূণ্য কুকুর পাছে কাছে আসে এইজন্য লোকে যেমন খাদ্যখণ্ড দূর হইতে ষ্টুড়িয়া দেয়, ইহারাও যেন তেমনি ক্ষুধার্ত মলিন ভিক্ষুককে দেখিলে দূর হইতে মুখ ফিরাইয়া এক মুঠা মুদ্রা অনায়াসে ফেলিয়া দিতে পারে । তাহাদের চক্ষে অধিকাংশ পৃথিবীর একপ্রকার যৎসামান্য ভাব ও ছিন্নবস্ত্ৰ অকিঞ্চনত যেন কেবল একটা মস্ত বেয়াদবি । তাহারা যে পৃথিবীতে সুখী ও সম্মানিত হইতেছে না, এ কেবল পৃথিবীর দোষ । গোবিন্দমাণিক্য যে ঠিক এতটা ভাবিয়ছিলেন তাহা নহে। তিনি লক্ষণ দেখিয়াই বুঝিয়াছিলেন যে, এই ফকির, এ যে আপনার বাসনা-সকল বিসর্জন দিয়া স্বাধীন ও সুস্থ হইয়া জগতের কাজ করিতে বাহির হইয়াছে তাহা নহে ; এ কেবল আপনার বাসনা তৃপ্ত হয় নাই বলিয়া রাগ করিয়া সমস্ত জগতের প্রতি বিমুখ হইয়া বাহির হইয়াছে। তিনি যাহা চান তাহাই তাহার পাওনা এইরূপ ফকিরের বিশ্বাস, এবং জগৎ তাহার নিকটে যাহা চায় তাহা সুবিধামত দিলেই চলিবে এবং না দিলেও কোনো ক্ষতি নাই । ঠিক এই বিশ্বাস-অনুসারে কাজ হয় নাই বলিয়া তিনি জগৎকে একঘরে করিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছেন । গোবিন্দমাণিক্যকে দেখিয়া ফকিরের রাজা বলিয়াও মনে হইল, সন্ন্যাসী বলিয়াও বোধ হইল । তিনি ঠিক এরূপ আশা করেন নাই । তিনি মনে করিয়াছিলেন হয় একটা লঙ্গোব্দর পাগড়ি-পরা স্ফীত মাংসপিণ্ড দেখিবেন, নয়তো একটা দীনবেশধারী মলিন সন্ন্যাসী অর্থাৎ ভস্মাচ্ছাদিত ধূলিশয্যাশায়ী উদ্ধত স্পর্ধা দেখিতে পাইবেন । কিন্তু দুয়ের মধ্যে কোনোটাই দেখিতে পাইলেন না । গোবিন্দমাণিক্যকে দেখিয়া বোধ হইল তিনি যেন সমস্ত ত্যাগ করিয়াছেন, তবু যেন সমস্তই তাহারই । তিনি কিছুই চান না বলিয়াই যেন পাইয়াছেন— তিনি আপনাকে দিয়াছেন বলিয়া পাইয়াছেন । তিনি যেমন আত্মসমর্পণ করিয়াছেন, তেমনি সমস্ত জগৎ আপনি ইচ্ছায় তাহার নিকটে ধবা দিয়াছে। কোনোপ্রকার আড়ম্বর নাই বলিয়া তিনি রাজা, এবং সমস্ত সংসারের নিতান্ত নিকটবতী হইয়াছেন বলিয়া তিনি সন্ন্যাসী । এইজন্য র্তাহাকে রাজাও সাজিতে হয় নাই, সন্ন্যাসীও সাজিতে হয় নাই । গ্রহণ করিলেন । ইহাতে যেন তাঁহাদের সম্পূর্ণ অধিকার ছিল। তঁহাদের আরামের জন্য কী কী দ্রব্য “পথশ্রমে অত্যন্ত শ্রান্তিবোধ হইয়াছে কি ?” বালক তাহার ভালোরূপ উত্তর না দিয়া ফকিরের কাছে ঘেষিয়া বসিল । রাজা তাহাদের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “তোমাদের এই সুকুমার শরীর তো পথে চলিবার জন্য নহে। তোমরা আমার এই দুর্গে বাস করো, আমি তোমাদিগকে যত্ন করিয়া রাখিব।” রাজার এই কথার উত্তর দেওয়া উচিত কি না এবং এই সকল লোকের সহিত ঠিক কিরূপ ভাবে ব্যবহার করা কর্তব্য তাহা বালকেরা ভাবিয়া পাইল না— তাহারা ফকিরের অধিকতর কাছে ঘেঁষিয়া