পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৭৯০
রবীন্দ্র-রচনাবলী

হচ্ছে এর ভাষা। নিশ্চিত বলতে পারি। নে কিন্তু আমার বিশ্বাস, বাংলা সাহিত্যে চলতি ভাষা লেখা বই এই প্রথম । আজ এর বয়স হল প্রায় ষাট । সে-ক্ষেত্রেও আমি ইতিহাসের দোহাই দিয়ে কৈফিয়ত দাখিল করব না। আমার বিশ্বাস বাংলা চলতি ভাষার সহজ প্রকাশপটুতার প্রমণ এই চিঠিগুলির মধ্যে আছে।

 তার পরে লেখার জঙ্গলগুলো সাফ করবামাত্র দেখা গেল, এর মধ্যে শ্রদ্ধা বস্তুটাই ছিল গোপনে, অশ্রদ্ধােটা উঠেছিল বাহিরে আগাছার মতো নিবিড় হয়ে । আসল জিনিসটাকে তার আচ্ছন্ন করেছিল, কিন্তু নষ্ট করে নি। এইটে আবিষ্কার করে আমার মন অত্যন্ত প্ৰসন্ন হয়েছে। কেননা, নিন্দা-নৈপুণ্যের প্রখর্য ও চতুর্যকে আমি সর্বািন্তঃকরণে ঘূণা করি । ভালো লাগবার শক্তিই বিধাতার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার মানবজীবনে । সাহিত্যে কুৎসাবিলাসীদের ভোজের দাদন আমি নিই নি, আর কিছু না হােক, এই পরিচয়টুকু আমি রেখে যেতে চাই ।

 একটা কথা আপনাকে বলা বাহুল্য । ইংরেজের চেহারা সেদিন আমার চোখে৷ যেমনটা ধরা পড়েছিল সেটা যে নেহাত আমার বাল্যবুদ্ধি ও অনভিজ্ঞতার সৃষ্টি সে কথা বললে সম্পূর্ণ সত্যু কথা বলা হবে না । এই প্রায় ষাট বছরের মধ্যে সেখানকার মানুষের যে পরিবর্তন হয়েছে তাকে ক্রমশ অভিব্যক্তির আখ্যা দেওয়া যায় না । এক-এক সময়ে ইতিহাস-শতদ্রঞ্চের বোড়ে তার এক পা চাল ছেড়ে দিয়ে লম্বা চালে চলতে শুরু করে । পাশ্চাত্যে তাই ঘটেছে। সেদিনকার পাসপোটে তার যে ছবিটা ছিল সে ছবি আজ একেবারেই চলবে না ।

 সেই প্রথম-বয়সে যখন ইংলন্ডে গিয়েছিলুম ঠিক মুসাফেরের মতো যাই নি। অর্থাৎ রাস্ত থেকে চলতে চলতে বাহির থেকে চোখ বুলিয়ে যাওয়া বরাদ্দ ছিল না । ছিলেম অতিথির মতে, ঘরের মধ্যে প্রবেশ পেয়েছিলুম। সেবা পেয়েছি, স্নেহ পেয়েছি, কোথাও কোথাও ঠিকেছি, দুঃখ পেয়েছি । কিন্তু তার পরে আবার যখন সেখানে গিয়েছি, তখন সভায় থেকেছি, ঘরে নয়! আমার তৎপূর্বকালের অভিজ্ঞতা সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ যদি না হয় তবু সত্য। যে ডাক্তারের বাড়িতে ছিলুম। তিনি ভদ্ৰশ্রেণীর এবং শ্রদ্ধেয়, কিন্তু সমুদয় ভদ্রশ্রেণীর প্রতীক তিনি না হতে পারেন । ইংলন্ডে আজও বর্ণসাম্য যতই থাক শ্রেণীভেদ যথেষ্ট । সেখানে এক শ্রেণীর সঙ্গে আর-এক শ্রেণীর মনোবৃত্তি ও ব্যবহারের মিল না থাকাই স্বাভাবিক । সেদিনও নিঃসন্দেহ ছিল না । আমি সেদিনকার সাধারণ গৃহস্থ-ঘরের এবং একটি বিলাসিনী-ঘরের পরিচয় কাছে থেকেই পেয়েছি । "তার কিছু কিছু বর্ণনা চিঠিগুলির মধ্যে আছে।

 কয়েকটি চিঠিতে তখনকার দিনের ইঙ্গবঙ্গের বিবরণ কিছু বিস্তারিত করেই দিয়েছি। আজ এরা লুপ্ত জীব। কোথাও কোথাও তার বর্তমান অভিব্যক্তির কিছু কিছু চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়, এমন-কি, র্যারা বিলেতে যান নি তাদেরও কারও কারও চালচলনে ইঙ্গবঙ্গী লক্ষণ অকস্মাৎ ফুটে ওঠে। সেকালের ইঙ্গবঙ্গদের অনেককে আমি প্রত্যক্ষ জানতুম। তাদের অনেকখানি পরিচয় পেয়েছি তাদের নিজেরই মুখ থেকে । যদি এর মধ্যে কোনো অত্যুক্তি থাকে। সে তাদেরই স্বকৃত । আমার সামনে বর্ণনায় নিজেদেরও বে-আবরু করতে ভয় পান নি, যেহেতু মুখচােরা ভালোমানুষ বালকটিকে তঁরা বিপদজনক বলে সন্দেহ করেন নি। আজ তাদের কাছে ক্ষম চাইতে গেলে আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে । তারা আছেন বৈতরণীর পরপারে ।

 আমার বিলাতের চিঠিতে ‘এবার মলে সাহেব হব গানটি উদধূত করেছিলেম । আমার স্নেহভাজন বন্ধু শ্ৰীযুক্ত চারু বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসের দৃষ্টান্তস্বরূপ। ঐ গানটি আমার রচনা বলে প্রচার করেছেন। তাতে অনামা রচয়িতার মান বেঁচে গেছে, কিন্তু আমার বঁাচে নি। আমার বিশ্বাস যথোচিত গবেষণা করলে আমার লেখা থেকে ওর চেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত পাওয়া যেতেও পারে ।

 এই পত্রগুলি যখন লেখা হয়েছিল তার বারো বছর পরে আর-এক বার বিলেতে