পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brのミ রবীন্দ্র-রচনাবলী দোকানে বসে গল্পগুজব করছে, দু-চার জন রাস্তার কোণে দাড়িয়ে হাসি-তামাশা করছে ; লোকজনেরা অতি নিশ্চিন্তমুখে গজেন্দ্রগমনে গমন করছে ; যেন কারও কোনো কােজ নেই, কারও কোনো ভাবনা নেই- যেন শহরসুদ্ধ ছুটি । রাস্তায় গাড়িঘোড়ার সমারোহ নেই, লোকজনের সমাগম নেই। আমরা খানিক দূর যেতেই একজন ছোকরা আমাদের গাড়ি থামিয়ে হাতে একটা তরমুজ নিয়ে গাড়োয়ানের পাশে গিয়ে বসল। ব- মহাশয় বললেন, “বিনা আয়াসে এর কিছু রোজগার করবার বাসনা আছে।” লোকটা এসে হাত বাড়িয়ে মাঝে মাঝে আমাদের দেখিয়ে দিতে লাগল, “ঐটে চার্চ, ঐটে বাগান, ঐটে মাঠ” ইত্যাদি । তার টীকাতে আমাদের কিছুমাত্র জ্ঞানবৃদ্ধি হয় নি, আর তার টীকা না হলেও আমাদের কিছুমাত্র জ্ঞানের ব্যাঘাত হত না । তাকে কেউ আমাদের গাড়িতে উঠতে বলে নি, কেউ তাকে কোনো বিষয় জিজ্ঞাসাও করে নি, কিন্তু তবু এই অযাচিত অনুগ্রহের জন্য তার যাচঞা পূর্ণ করতে হল। তারা আমাদের একটা ফলের বাগানে নিয়ে গেল । সেখানে যে কত প্রকার ফলের গাছ, তার সংখ্যা নেই । চার দিকে থোলো থােলো আঙুর ফলে রয়েছে। দু-রকম আঙুর আছে, কালো আর সাদা । তার মধ্যে কালোগুলিই আমার বেশি মিষ্টি লাগল। বড়ো বড়ো গাছে আপেল পিচ প্রভৃতি অনেক প্রকার ফল ধরে আছে। একজন বুড়ি (বোধ হয় উদ্যানপালিকা) কতকগুলি ফলফুল নিয়ে উপস্থিত করলে | আমরা সে দিকে নজর করলেম না ; কিন্তু ফল বিক্রয় করবার উপায় সে বিলক্ষণ জানে । আমরা ইতস্তত বেড়াচ্ছি, এমন সময়ে দেখি একটি সুন্দরী মেয়ে কতকগুলি ফল আর ফুলের তোড়া নিয়ে আমাদের সম্মুখে হাজির হল, তখন আর অগ্রাহ্য করবার সাধ্য রইল না । ইটালির মেয়েদের বড়ো সুন্দর দেখতে । অনেকটা আমাদের দেশের মেয়ের ভাব আছে। সুন্দর রঙ, কালো কালো চুল, কালো ভুরু, কালো চোখ, আর মুখের গড়ন চমৎকার । তিনটের ট্রেনে ব্রিন্দিসি ছাড়লেম । রেলোয়ে পথের দু-ধারে আঙুরের খেত, চমৎকার দেখতে । দিকে শোভা পাচ্ছে । গাছপালার মধ্যে থেকে যখন কোনো একটি দূরস্থ নগর, তার প্রাসাদচুড়া, তার চার্চের শিখর, তার ছবির মতো বাড়িগুলি আস্তে আস্তে চোখে পড়ে তখন বড়ো ভালো লাগে । সন্ধেবেলায় একটি পাহাড়ের নীচে অতি সুন্দর একটি হ্রদ দেখেছিলেম, তা আর আমি ভুলতে পারব না । তার চার দিকে গাছপালা, জলে সন্ধ্যার ছায়া— সে অতি সুন্দর, তা আমি বর্ণনা করতে চাই নে । রেলোয়ে করে যেতে যেতে আমরা Mont Cenis-এর বিখ্যাত সুরঙ্গ দেখলেম । এই পর্বতের এ-পাশ থেকে ফরাসিরা ও-পাশ থেকে ইটালিয়ানরা, একসঙ্গে খুন্দতে আরম্ভ করে, কয়েক বৎসর খুন্দতে খুন্দতে দুই যান্ত্রিদল ঠিক মাঝামাঝি এসে পরস্পরের সমুখাসমুখি হয়। এই গুহা অতিক্রম করতে রেলগাড়ির ঠিক আধা ঘণ্টা লাগল। সে অন্ধকারে আমরা যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেম। এখানকার রেলগাড়ির মধ্যে দিনরাত আলো জ্বালাই আছে, কেননা এক-এক স্থানে প্ৰায় পাচ মিনিট অন্তর এক-একটা পর্বতগুহা ভেদ করতে হয়— সুতরাং দিনের আলো খুব অল্পক্ষণ পাওয়া যায় । ইটালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা— নিঝর নদী পর্বত গ্রাম হ্রদ দেখতে দেখতে আমরা পথের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেম । সকালবেলায় প্যারিসে গিয়ে পৌঁছলেম । কী জমকালো শহর । অভ্ৰভেদী প্রাসাদের অরণ্যে অভিভূত হয়ে যেতে হয় । মনে হয়। প্যারিসে বুঝি গরিব লোক নেই। মনে হল, এই সাড়ে তিন হাত মানুষের জন্যে এমন প্ৰকাণ্ড জমকালো বাড়িগুলোর কী আবশ্যক । হােটেলে গেলেম, এমন প্রকাণ্ড কাণ্ড যে, ঢিলে কাপড় পরে যেমন সোয়াস্তি হয় না, সে হােটেলেও বোধ করি তেমনি অসোয়ন্তি হয় । স্মরণস্তম্ভ, উৎস, বাগান, প্রাসাদ, পাথরে বাধানাে রাস্তা, গাড়ি, ঘোড়া, জনকোলাহল প্রভৃতিতে অবাক হয়ে যেতে হয়। প্যারিসে পৌঁছিয়েই আমরা একটা টার্কিশ-বাথে গেলেম। প্রথমত একটা খুব গরম ঘরে গিয়ে বসলেম, সে-ঘরে অনেকক্ষণ থাকতে থাকতে কারো কারো ঘাম বেরতে লাগল, কিন্তু আমার তো বেরল না, আমাকে তার চেয়ে আর-একটা গরম ঘরে নিয়ে গেল, সে ঘরটা আগুনের মতো, চোখ মেলে থাকলে চোখ জ্বালা করতে থাকে, মিনিট কতক থেকে সেখানে আর থাকতে