পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী א צbr কান্নাকাটি জুড়ে দেয় নি, নিরিবিলি নিরালা, কোনো হাঙ্গামা নেই।” দেশের সম্বন্ধে মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। প্রায় দেখা যায় আমাদের দেশের পুরুষেরা এখানকার পুরুষ-সমাজে বড়ো মেশেন না । কারণ এখানকার পুরুষ-সমাজে মিশতে গেলে একরকম বলিষ্ঠ স্মৃর্তির ভাব থাকা চাই, বাধাে-বাধো মিঠে সুরে দু-চারটে সসংকোচ “হা না” দিয়ে গেলে চলে না । বাঙালি অভ্যাগত ডিনার টেবিলে তার পার্শ্বস্থ মহিলাটির কানে কানে মিষ্টি মিষ্টি টুকরো টুকরো দুই-একটি কথা মৃদু ধীর স্বরে কইতে পারেন, আর সে মহিলার সহবাসে তিনি যে স্বৰ্গ-সুখ উপভোগ করছেন, তা তার মাথার চুল থেকে বুট জুতোর আগ পর্যন্ত প্রকাশ হতে থাকে, সুতরাং মেয়ে-সমাজে বাঙালিরা পসার করে নিতে পারেন । আমাদের দেশের ঘোমটাচ্ছন্ন-মুখচন্দ্ৰ-শোভী অনালোকিত অন্তঃপুর থেকে এখানকার রূপের মুক্ত জ্যোৎস্নায় এসে আমাদের মন-চকোর প্রাণ খুলে গান গেয়ে ওঠে ! একদিন আমাদের নবাগত বঙ্গযুবক তার প্রথম ডিনারের নিমন্ত্রণে গিয়েছেন। নিমন্ত্রণসভায় নতুন নতুন এসে এখানকার স্ত্রীলোকদের ভাবও ঠিক বুঝতে পারি নে। কোনো সামাজিকতার অনুরোধে তারা আমাদের মনোরঞ্জন করবার জন্যে যে-সকল কথাবার্তা হাস্যালাপ করে, আমরা তার ঠিক মর্মগ্রহণ করতে পারি নে, আমরা হঠাৎ মনে করি, আমাদের উপরেই এই মহিলাটির বিশেষ অনুকুল দৃষ্টি । আমাদের বঙ্গযুবকটি মিসকে ভারতবর্ষ সংক্রান্ত অনেক কথা জানালেন। বললেন তার কুসংস্কার আছে। শেষকালে দুই-একটি সাজানো কথাও বললেন । যথা, তিনি সুন্দরবনে বাঘ শিকার করতে গিয়ে একবার মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন । মিসটি অতি সহজে বুঝতে পারলেন যে, এই যুবকের তাকে অত্যন্ত ভালো লেগেছে। তিনি যথেষ্ট সন্তুষ্ট হলেন ও তার মিষ্টতম বাক্যবাণ যুবকের প্ৰাণে হানতে লাগলেন । “আহা, কী গোছালো কথা ! কোথায় আমাদের দেশের মেয়েদের মুখের সেই নিতান্ত শ্রমলভ্য দুই-একটি ‘ই না’ যা এত মৃদু যে ঘোমটার সীমার মধ্যেই মিলিয়ে যায় ; আর কোথায় এখানকার বিম্বৌষ্ঠ-নিঃসৃত অজস্র মধুধারা, যা অযাচিতভাবে মন্দিরার মতো শিরায় শিরায় প্রবেশ করে !” হয়তো বুঝতে পারছি, কী কী মসলার সংযোগে বাঙালি বলে একটা পদার্থ ক্ৰমে ইঙ্গবঙ্গ নামে একটা খিচুড়িতে পরিণত হয় । সমস্ত প্রক্রিয়াটা বিস্তারিত করে লিখতে পারি নি। এত-সব ছোটাে ছোটাে বিষয়ের সমষ্টি মানুষের মনে অলক্ষিত পরিবর্তন উপস্থিত করে যে, সে-সকল খুঁটিনাটি করে বর্ণনা করতে গেলে পুঁথি বেড়ে যায়। 战 ইঙ্গবঙ্গদের ভালো করে চিনতে গেলে তাদের তিনরকম অবস্থায় দেখতে হয় । তারা ইংরেজদের সম্মুখে কী রকম ব্যবহার করেন, বাঙালিদের সম্মুখে কী রকম ব্যবহার করেন ও তাদের স্বজাত ইঙ্গবঙ্গদের সম্মুখে কী রকম ব্যবহার করেন। একটি ইঙ্গবঙ্গকে একজন ইংরেজের সম্মুখে দেখো, চক্ষু জুড়িয়ে যাবে। ভদ্রতার ভারে প্রতি কথায় ঘাড় নুয়ে নুয়ে পড়ছে, তর্ক করবার সময় অতিশয় সাবধানে নরম করে প্রতিবাদ করেন ও প্রতিবাদ করতে হল বলে অপৰ্যাপ্ত দুঃখ প্রকাশ করেন, অসংখ্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন । কথা কন আর না কন, একজন ইংরেজের কাছে একজন ইঙ্গবঙ্গ চুপ করে বসে থাকলেও তার প্রতি অঙ্গভঙ্গি, প্ৰতি মুখের ভাবে বিনয়ের পরাকাষ্ঠা প্ৰকাশ হতে থাকে । কিন্তু তাকেই আবার তার স্বজাতিমণ্ডলে দেখো, দেখবে তার মেজাজ । বিলেতে যিনি তিন বৎসর আছেন, এক বৎসরের বিলেতবাসীর কাছে তার অত্যন্ত পায়া-ভারী । এই তিন বৎসর ও এক বৎসরের মধ্যে যদি কখনো তর্ক ওঠে, তাহলে তুমি “তিন বৎসরের” প্ৰতাপটা একবার দেখতে পাও । তিনি প্ৰতি কথা এমন ভাবে, এমন স্বরে বলেন যে, যেন সেই কথাগুলি নিয়ে সরস্বতীর সঙ্গে তার বিশেষ বোঝাপড়া হয়ে একটা স্থিরসিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। যিনি প্রতিবাদ করছেন তাকে তিনি স্পষ্টীক্ষরে বলেন ‘ভ্ৰান্ত', কখনো বা মুখের উপর বলেন “মুখ ।