পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-প্রবাসীর পত্ৰ brs> রস যোগ করে ফ্লার্ট এবং হয়তো লাভ করা তাদের দিনকৃত্য। আমাদের দেশে যেমন ছেলেবেলা থেকে মেয়েদের বিয়ের জন্যে প্ৰস্তুত করে, যথেষ্ট লেখাপড়া শেখায় না, কেননা মেয়েদের আপিসে যেতে হবে না, এখানেও তেমনি মাগগি দরে বিকোবার জন্যে মেয়েদের ছেলেবেলা থেকে পালিশ করতে থাকে, বিয়ের জন্যে যতটুকু লেখাপড়া শেখা দরকার ততটুকু যথেষ্ট । একটু গান গাওয়া, একটু পিয়ানো বাজানো, ভালো করে নাচা, খানিকটা ফরাসি ভাষা বিকৃত উচ্চারণ, একটু বোনা ও সেলাই করা জানলে একটি মেয়েকে বিয়ের দোকানের জানলায় সাজিয়ে রাখবার উপযুক্ত রঙচঙে পুতুল গড়ে তোলা যায়। এ-বিষয়ে একটা দিশি পুতুল ও একটা বিলিতি পুতুলের যতটুকু তফাত, আমাদের দেশের ও এ-দেশের মেয়েদের মধ্যে ততটুকু তফাত মাত্র । আমাদের দিশি মেয়েদের পিয়ানো ও অন্যান্য টুকিটাকি শেখবার দরকার করে না, বিলিতি মেয়েদেরও অল্পস্বল্প লেখাপড়া শিখতে হয়, কিন্তু দুই-ই দোকানে বিক্রি হবার জন্যে তৈরি । এখানেও পুরুষেরাই হর্তাকর্তা, স্ত্রীরা তাদের অনুগত ; স্ত্রীকে আদেশ করা, স্ত্রীর মনে লাগাম লাগিয়ে নিজের ইচ্ছেমত চালিয়ে বেড়ানো স্বামীরা ঈশ্বর নির্দিষ্ট অধিকার মনে করেন । ফ্যাশনী মেয়ে ছাড়া বিলোতে আরো অনেকরকম মেয়ে আছে, নইলে সংসার চলত না । মধ্যবিত্ত গৃহস্থ মেয়েদের অনেকটা মেহনত করতে হয়, বাবুয়ানা করলে চলে না । সকালে উঠে একবার রান্নাঘর তদারক করতে হয়, সে ঘর পরিষ্কার আছে কি না, জিনিসপত্র যথা পরিমিত আনা হয়েছে কি না, যথাস্থানে রাখা হয়েছে কি না ইত্যাদি দেখাশুনো করা ; রান্না ও খাবার জিনিস আনতে হুকুম দেওয়া, পয়সা বঁাচাবার জন্যে নানাপ্রকার গিন্নিপনার চাতুরী খেলা, কালকের মাংসের হাড়গোড় কিছু যদি অবশিষ্ট থাকে তা হলে বন্দােবস্ত করে তার থেকে আজকের সৃপ চালিয়ে নেওয়া, পরশু দিনকার বাসি রাধা মাংস যদি খাওয়া-দাওয়ার পর খানিকটা বাকি থাকে তা হলে সেটাকে রূপান্তরিত করে আজকের টেবিলে আনবার সুবিধে করে দেওয়া, এইরকম নানাপ্রকার গৃহিণীপনা । তার পর ছেলেদের জন্য মোজা কাপড়-চোপড়, এমন-কি. নিজেরও অনেক কাপড় নিজে তৈরি করেন । এদের সকলের ভাগ্যে নভেল পড়া ঘটে ওঠে না ; বড়ো জোর খবরের কাগজ পড়েন, তাও সকলে পড়েন না দেখেছি ; অনেকের পড়াশুনোর মধ্যে কেবল চিঠি পড়া ও চিঠি লেখা, দোকানদারদের বিল পড়া ও হিসাব লেখা । তারা বলেন, “পলিটিকস এবং অন্যান্য গ্ৰাম্ভারি বিষয় নিয়ে পুরুষেরা নাড়াচাড়া করুন ; আমাদের কর্তব্য কাজ স্বতন্ত্র ।” দুর্বলতা মেয়েদের একটা গর্বের বিষয় ; সুতরাং অনেক মেয়ে শ্রান্ত না হলেও এলিয়ে পড়েন । বুদ্ধিবিদ্যার বিষয়েও এইরকম ; মেয়েরা জাক করে বলেন, “আমরা বাপু ও-সব বুঝি সুঝি নে ৷” বিদ্যার অভাব বুদ্ধির খর্বতা একটা প্রকাশ্য র্জাকের বিষয় হয়ে ওঠে । এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেয়েরা বিদ্যাচর্চার দিকে ততটা মনোযোগ দেন না, তাদের স্বামীরাও তার জন্যে বড়ো দুঃখিত নন, তাদের জীবন হচ্ছে কতকগুলি ছোটােখাটাে কাজের সমষ্টি । সন্ধেবেলায় স্বামী কর্মক্ষেত্র থেকে এলে একটি আদরের চুম্বন উপার্জন করেন (পরিবার-বিশেষে যে তার অন্যথা হয় তা বলাই বাহুল্য) ; ঘরে তার জন্যে আগুন জ্বালানো, খাবার সাজানো আছে । সন্ধেবেলায় স্ত্রী হয়তো একটা সেলাই নিয়ে বসলেন, স্বামী তাকে একটি নভেল চেচিয়ে পড়ে শোনাতে লাগলেন, সুমুখে আগুন জ্বলছে, ঘরটি বেশ গরম, বাইরে পড়ছে বৃষ্টি, জানলা-দরজাগুলি বন্ধ। হয়তো স্ত্রী পিয়ানো বাজিয়ে স্বামীকে খানিকটা গান শোনালেন । এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গিন্নিরা সাদাসিধে । যদিও তারা ভালো করে লেখাপড়া শেখেন নি, তবু তারা অনেক বিষয় জানেন, এবং তাদের বুদ্ধি যথেষ্ট পরিষ্কার । এ দেশে কথায় বার্তায় জ্ঞানলাভ করা যায়, তারা অন্তঃপুরে বদ্ধ নন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলাপ করেন, আত্মীয়-সভায় একটা কোনো উচ্চ বিষয় নিয়ে চর্চা হলে তারা শোনেন ও নিজের বক্তব্য বলতে পারেন, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা একটা বিষয়ের কত দিক দেখেন ও কী রকম চক্ষে দেখেন তা বুঝতে পারেন। সুতরাং একটা কথা উঠলে কতকগুলো ছেলেমানুষি আকাশ-থেকে-পড়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন না ও তাকে হঁহা করে থাকতে হয় না । বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খুব সহজভাবে গল্পসল্প করতে পারেন, নিমন্ত্রণসভায় মুখ ভার করে বা লজ্জায় অবসন্ন হয়ে থাকেন না, পরিচিতদের সঙ্গে অন্যায় ঘেঁষাৰ্ঘেষি নেই, কিংবা তাদের কাছ থেকে নিতান্ত অসামাজিক ভাবে দূরেও থাকেন না।