পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br史8 রবীন্দ্র-রচনাবলী দাঁড়ায় । টনব্রিজ ওয়েলস অনেক দিন থেকে তার লীেহপদার্থমিশ্রিত উৎসের জন্যে বিখ্যাত । এই উৎসের জল খাবার জন্যে এখানে অনেক যাত্রীর সমাগম হয় । উৎস৷ শুনেই আমরা কল্পনা করলেম— না জানি কী সুন্দর দৃশ্য হবে ; চারি দিকে পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, সারসমর্যালকুল-কৃজিত, কমলকুমুদকহলার-বিকশিত সরোবর, কোকিল-কৃজন, মলয়-বীজন, ভ্রমর-গুঞ্জন ও অবশেষে এই মনোরম স্থানে পঞ্চশরের প্রহার ও এক ঘটি জল খেয়ে বাড়ি ফিরে আসা | গিয়ে দেখি, একটা হাটের মধ্যে একটা ছোটাে গর্ত পাথর দিয়ে বাধানো, সেখানে একটু একটু করে জল উঠছে, একটা বুড়ি কাচের গেলাস হাতে দাড়িয়ে । এক-এক পেনি নিয়ে এক-এক গেলাস জল বিতরণ করছে ও অবসর মত একটা খবরের কাগজে গতরাত্রের পার্লামেন্টের সংবাদ পড়ছে । চার দিকে দোকানবাজার ; গাছপালার কোনো সম্পর্ক নেই ; সম্মুখেই একটা কসাইয়ের দোকান, সেখানে নানা চতুস্পদের ও “হংসমর্যালকুল”-এর ডানা ছাড়ানো মৃতদেহ দড়িতে ঝুলছে ; এই-সব দেখে আমার মন এমন চটে উঠিল যে, কোনোমতে বিশ্বাস হল না যে, এ জলে কোনোপ্রকার রোগ নিবারণ বা শরীরের উন্নতি হতে পারে । টনব্রিজ ওয়েলস শহরটা খুব ছোটাে, দু-পা বেরোলেই গাছপালা মাঠ দেখতে পাওয়া যায়। বাড়িগুলো লন্ডনের মতো থামবারান্দাশূন্য, ঢালু ছাত ওআলা সারি সারি একঘেয়ে ভাবে দাড়িয়ে ; অত্যন্ত শ্ৰীহীন দেখতে । দোকানগুলো তেমনি সুসজ্জিত, পরিপাটি, কাচের জানলা দেওয়া । কঁচের ভিতর থেকে সাজানো পণ্যদ্রব্য দেখা যাচ্ছে ; কসাইয়ের দোকানে কোনোপ্রকার কাচের আবরণ নেই, চতুস্পদের আস্ত আস্ত পা ঝুলছে— ভেড়া, গোরু, শুওর, বাছুরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নানাপ্রকার ভাবে চোখের সামনে টাঙিয়ে রাখা, হাস প্রভৃতি নানাপ্রকার মরা পাখি লম্বা লম্বা গলাগুলো নীচের দিকে ঝুলিয়ে আছে, আর খুব একটা জোয়ান পেটমোটা ব্যক্তি হাতে একটা প্ৰকাণ্ড ছুরি নিয়ে কোমরে একটা বিলেতের ভেড়াগোরুগুলো তাদের মোটাসোটা মাংসচর্বিওআলা শরীরের ও সুস্বাদের জন্যে বিখ্যাত, যদি কোনো মানুষ-খেগো সভ্যজাত থাকত, তা হলে বোধ হয় বিলেতের কসাইগুলো তাদের হাটে অত্যন্ত মাগগি দামে বিকোত । একজন মেমসাহেব বলেন যে, কসাইয়ের দোকান দেখলে তার অত্যন্ত তৃপ্তি হয় ; মনে আশ্বাস হয়, দেশে আহারের অপ্রতুল নেই, দেশের পেট ভরবার মতো খাবার প্রচুর আছে, দুর্ভিক্ষের কোনো সম্ভাবনা নেই। ইংরেজদের খাবার টেবিলে যেরকম আকারে মাংস এনে দেওয়া হয়, সেটা আমার কাছে দুঃখজনক । কেটে-কুট মসলা দিয়ে মাংস তৈরি করে আনলে একরকম ভুলে যাওয়া যায় যে একটা সত্যিকার জন্তু খেতে বসেছি ; কিন্তু মুখ-পা-বিশিষ্ট আস্ত প্ৰাণীকে অবিকৃত আকারে টেবিলে এনে দিলে একটা মৃতদেহ খেতে বসেছি বলে গা কেমন করতে থাকে | নাপিতের দোকানের জানলায় নানাপ্রকার কাঠের মাথায় নানাপ্রকার কোকড়ানো পরচুলো বসানো রয়েছে, দাড়িগোফ ঝুলছে, মার্কামারা শিশিতে টাকনাশক চুল-উঠে-যাওয়া-নিবারক অব্যর্থ ওষুধ রয়েছে ; দীর্ঘকেশী মহিলারা এই দোকানে গেলে সেবকেরা (সেবিকা নয়) তাদের মাথা ধুয়ে দেবে, চুল বেঁধে দেবে, চুল কুঁকড়ে দেবে। এখানে মদের দোকানগুলোই সব চেয়ে জমকালো, সন্ধের সময় সেগুলো আলোয় আকীর্ণ হয়ে যায়, বাড়িগুলো প্ৰায় প্রকাণ্ড হয়, ভিতরটা খুব বড়ো ও সাজানো, খন্দেরের ঝাক দোকানের বাইরে ও ভিতরে সর্বদাই, বিশেষত সন্ধেবেলায় লেগে থাকে । দরজির দোকানও মন্দ নয় । নানা ফ্যাশনের সাজসজা কাচের জানলার ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে, বড়ো বড়ো কাঠের মূর্তিকে কাপড় পরিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ; মেয়েদের কাপড়াচোপড় এক দিকে ঝোলানো ; এইখানে কত লুব্ধ নেত্ৰ দিনরাত্রি তাকিয়ে আছে তার সংখ্যা নেই। এখানকার বিলাসিনীরা, যাদের নতুন ফ্যাশনের দামি কাপড় কেনবার টাকা নেই, তারা দোকানে এসে কাপড়গুলো ভালো করে দেখে যায়, তার পরে বাড়িতে গিয়ে সস্তায় নিজের হাতে তৈরি করে । আমাদের বাড়ির কাছে একটা খোলা পাহাড়ে জায়গা আছে ; সেটা কমন অর্থাৎ সরকারি জায়গা ;