পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brミや রবীন্দ্র-রচনাবলী পাহাড় । অতি পরিষ্কার দিন । মেঘ নেই, কুয়াশা নেই, অন্ধকার নেই ; চারি দিকে গাছপালা, চারি দিকে পাখি ডাকছে, ফুল ফুটছে । যখন টনব্রিজ ওয়েলসে ছিলুম, তখন ভাবতুম এখানে যদি মদন থাকে, তবে অনেক বনবাদােড় ঝোপঝাপ কঁাটাগাছ হাতড়ে দু-চারটে বুনোফুল নিয়েই কোনোমতে তাকে ফুলশার বানাতে হয় । কিন্তু টার্কিতে মদন যদি গ্যােটলিং কামানের মতো এমন একটা বাণ উদভাবন করে থাকে, যার থেকে প্রতি মিনিটে হাজারটা করে তীর ছোড়া যায় আর সেই বাণ দিনরাত যদি কাজে ব্যস্ত থাকে, তবু মদনের ফুলশরের তহবিল এখানে দেউলে হবার কোনো সম্ভাবনা নেই, এত ফুল ; যেখানে-সেখানে, পথে-ঘাটে, ফুল মাড়িয়ে চলতে হয় । আমরা রোজ পাহাড়ে বেড়াতে যাই । গোরু চরছে, ভেড়া চরছে ; এক-এক জায়গায় রাস্তা এত ঢালু যে, উঠতে-নাবিতে কষ্ট হয় । এক-এক জায়গায় খুব সংকীর্ণ পথ, দু। ধারে গাছ উঠেছে আঁধার করে, ওঠবার সুবিধের জন্যে ভাঙা ভাঙা সিঁড়ির মতন আছে, পথের মধ্যেই লতা-গুল্ম উঠেছে। চার দিকে মধুর রোদুর । এখানকার' বাতাস বেশ গরম, ভারতবর্ষ মনে পড়ে । এইটুকু গরমেই লন্ডনের প্রাণীদের চেয়ে এখানকার জীবজন্তুদের কত নিজীবি ভাব প্রত্যক্ষ করা যায় । ঘোড়াগুলো আস্তে আস্তে যাচ্ছে, মানুষগুলোর তেমন ভারি ব্যস্ত ভর্বি নেই, গড়িমসি করে চলেছে ! এখানকার সমুদ্রের ধারা আমার বড়ো ভালো লাগে । যখন জোয়ার আসে, তখন সমুদ্রতীরের খুব প্ৰকাণ্ড পাথরগুলো জলে ডুবে যায়, তাদের মাথা বেরিয়ে থাকে । ছোটাে ছোটাে দ্বীপের মতো দেখায় । জলের ধারেই ছোটাে বড়ো কত পাহাড় । ঢেউ লেগে লেগে পাহাড়ের নীচে গুহা তৈরি হয়ে গেছে ; যখন ভাটা পড়ে যায়, তখন আমরা এক-একদিন এই গুহার মধ্যে গিয়ে বসে থাকি । গুহার মধ্যে জায়গায় জায়গায় অতি পরিষ্কার একটু জল জমে রয়েছে, ইতস্তত সমুদ্র-শৈবাল জমে আছে, সমুদ্রের একটা স্বাস্থ্যজনক গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, চার দিকে পাথর ছড়ানো । আমরা সবাই মিলে এক-একদিন সেই পাথরগুলো ঠেলা ঠেলি করে নাড়াবার চেষ্টা করি, নানা শামুক ঝিনুক কুড়িয়ে নিয়ে আসি। এক-একটা পাহাড় সমুদ্রের জলের উপর খুব ঝুকে পড়েছে ; আমরা প্রাণপণ করে এক-একদিন সেই অতি দুৰ্গম পাহাড়গুলোর উপর উঠে বসে নীচে সমুদ্রের ঢেউয়ের ওঠাপড়া দেখি । হু হু শব্দ উঠছে, ছোটাে ছোটাে নীেকো পাল তুলে চলে যাচ্ছে, চার দিকে রোদ্দুর, মাথার উপর ছাতা খোলা, পাথরের উপর মাথা দিয়ে আমরা শুয়ে শুয়ে গল্প করছি । আলস্যে কাল কাটাবার এমন জায়গা আর কোথায় পাব ? এক-এক দিন পাহাড়ে যাই, আর পাথর-দিয়ে-ঘেরা ঝোপেকাপে-ঢাকা একটি প্রচ্ছন্ন জায়গা দেখলে সেই খাদটিতে গিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসি । দশম পত্ৰ ক্রিসমাস ফুরোল, আবার দেখতে দেখতে আর-একটা উৎসব এসে পড়ল। আজ নূতন বর্ষের প্রথম দিন । কিন্তু তার জন্যে কিছুই গোলমাল দেখতে পাচ্ছি নে ! নূতন বৎসর যে এখানে এমন নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আসবে তা জানতেম না । শুনেছি ফ্রান্সে লোকে নতুন বৎসরকে খুব সমাদরের সঙ্গে আহবান করে । কাল পুরাতন বৎসরের শেষ রাত্রে আমাদের প্রতিবেশীরা বাড়ির জানলা খুলে রেখেছিল। পাছে পুরোনা বৎসর ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে থাকে, পাছে নতুন বৎসর এসে জানলার কাছে বৃথা ঘুরে ঘুরে বেড়ায় । টার্কি থেকে বহুদিন হল আমরা আবার লন্ডনে এসেছি। এখন আমি ক—র পরিবারের মধ্যে বাস করি। তিনি, তার স্ত্রী, তাদের চার মেয়ে, দুই ছেলে, তিন দাসী, আমি ও টেবি বলে এক কুকুর নিয়ে এই বাড়ির জনসংখ্যা । মিস্টার ক- একজন ডাক্তার । তার মাথার চুল ও দাড়ি প্রায় সমস্ত পাকা । বেশ বলিষ্ঠ ও সুশ্ৰী দেখতে । অমায়িক স্বভাব, অমায়িক মুখশ্ৰী মিসেস ক— আমাকে আন্তরিক যত্ন করেন । শীতের সময় আমি বিশেষ গরম কাপড় না পরলে তার কাছে ভৎসনা খাই । খাবার সময় যদি তার মনে হয় আমি কম করে খেয়েছি, তা হলে যতক্ষণ না তীর মনের মতো খাই ততক্ষণ পীড়াপীড়ি