পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি br○a সমুদ্র এই দেহ হতে ভারতবর্ষটাকে যেন বঁাকিয়ে বঁকিয়ে একেবারে সাফ করে ফেলবার চেষ্টা করছে। ক্যাবিনে চারদিন পড়ে আছি। ২৬ আগস্ট । শনিবার থেকে আর আজ এই মঙ্গলবার পর্যন্ত কেটে গেল । জগতে ঘটনা বড়ো কম হয় নি- সূর্য চারবার উঠেছে এবং তিনবার অস্ত গেছে, বৃহৎ পৃথিবীর অসংখ্য জীব দন্তধাবন থেকে দেশ-উদ্ধার পর্যন্ত বিচিত্র কর্তব্যের মধ্যে দিয়ে তিনটে দিন মহা ব্যস্তভাবে অতিবাহিত করেছেজীবনসংগ্রাম, প্রাকৃতিক নির্বাচন, আত্মরক্ষা, বংশরক্ষা প্রভৃতি জীবরাজ্যের বড়ো বড়ো ব্যাপার সবেগে চলছিল— কেবল আমি শয্যাগত জীবন্মত হয়ে পড়েছিলুম। আধুনিক কবিরা কখনো মুহুর্তকে অনন্ত কখনো অনন্তকে মুহূর্ত আখ্যা দিয়ে প্রচলিত ভাষাকে নানাপ্রকার বিপরীত-ব্যায়াম-বিপাকে প্রবৃত্ত করান। আমি আমার এই চারটে দিনকে বড়ো রকমের একটা মুহুর্ত বলব, না। এর প্রত্যেক মুহুর্তকে একটা যুগ বলব স্থির করতে পারছি নে । যাই হােক কষ্টের সীমা নেই। মানুষের মতো এতবড়ো একটা উন্নত জীব যে সহসা এতটা উৎকট দুঃখ ভোগ করে তার একটা মহৎ নৈতিক কিংবা আধ্যাত্মিক কারণ থাকাই উচিত ছিল ; কিন্তু জলের উপরে কেবল খানিকটা ঢেউ ওঠার দরুন জীবাত্মার এত বেশি পীড়া নিতান্ত অন্যায় অসংগত এবং ” আগৌরবজনক বলে বোধ হয় । কিন্তু জাগতিক নিয়মের প্রতি দোষারোপ করে কোনো সুখ নেই, কারণ সে নিন্দাবাদে কারো গায়ে কিছু ব্যথা বাজে না, এবং জগৎ-রচনার তিলমাত্র সংশোধন হয় না । যন্ত্রণাশয্যায় অচেতন্যপ্ৰায় ভাবে পড়ে আছি । কখনো কখনো ডেকের উপর থেকে পিয়ানোর সংগীত মৃদু মৃদু কর্ণে এসে প্রবেশ করে, তখন স্মরণ হয় আমার এই সংকীর্ণ শয়ন-কারাগারের বাইরে সংসারের নিত্য আনন্দস্রোত সমভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। বহুদূরে ভারতবর্ষের পূর্বসীমায় আমার সেই সংগীতধ্বনিত স্নেহমধুর গৃহ মনে পড়ে। সুখ-স্বাস্থ্য-সৌন্দর্যময় জীবজগৎকে অতি দূরবতী ছায়ারাজ্যের মতো বোধ হয় | মধ্যের এই সুদীর্ঘ মরুপথ অতিক্রম করে কখন সেখানকার জীবন-উৎসবের মধ্যে ফিরে যেতে পারব, এই কথাই কেবল ভাবি । মঙ্গলবার প্রাতে যখন শরীরের মধ্যে প্ৰাণটা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, তখন আমার বন্ধু অনেক আশ্বাস দিয়ে আমাকে জাহাজের ছাদের উপরে নিয়ে গেলেন ; সেখানে লম্বা বেতের চোকিটির উপর পা ছড়িয়ে বসে পুনর্বাের এই মর্ত পৃথিবীর স্পর্শ এবং নবজীবনের আস্বাদ লাভ করা গেল । জাহাজের যাত্রীদের বর্ণনা করতে চাই নে। অতিনিকট হতে কোনাে মসীলিপ্ত লেখনীর সূচ্যগ্ৰভাগ যে তাদের প্রতি তীক্ষ লক্ষ স্থাপন করতে পারে এ কথা তারা স্বপ্নেও না মনে করে বেশ বিশ্বাস্তচিত্তে ডেকের উপর বিচরণ করছে, টুংটাং শব্দে পিয়ানো বাজাচ্ছে, বাজি রেখে হার-জিত খেলছে, ধূমপানশালায় বসে তাস পিটােচ্ছে ; তাদের সঙ্গে আমার কোনাে সম্পর্ক নেই। আমরা তিন বাঙালি তিন লম্বা চৌকিতে জাহাজের একটি প্রান্ত সম্পূর্ণ অধিকার করে অবশিষ্ট জনসংখ্যার প্রতি অত্যন্ত ঔদাস্যদৃষ্টিপাত করে থাকি । আমার সঙ্গী যুবকটির নিত্যকর্ম হচ্ছে তামাকের থলিটি বার বার হারানাে, তার সন্ধান এবং উদ্ধারসাধন । আমি তাকে বারংবার সতর্ক করে দিয়েছি যে, যদি তার মুক্তির কোনো ব্যাঘাত থাকে সে র্তার চুরুট । মহর্ষি ভরত মৃত্যুকালেও হরিণশিশুর প্রতি চিত্তনিবেশ করেছিলেন বলে পরজন্মে হরিণশাবক হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন । আমার সর্বদাই আশঙ্কা হয়, আমার বন্ধু জন্মান্তরে ব্ৰহ্মদেশীয় কোন এক কৃষকের কুটিরের সম্মুখে মস্ত একটা তামাকের খেত হয়ে উদভূত হবেন । বিনা প্রমাণে তিনি শাস্ত্রের এ-সকল কথা বিশ্বাস করেন না, বরঞ্চ তর্ক করে আমারও সরল বিশ্বাস নষ্ট করতে চান এবং আমাকে পর্যন্ত চুরুট ধরাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু এ পর্যন্ত কৃতকার্য হতে পারেন নি। ২৭। ২৮ আগস্ট । দেবাসুরগণ সমুদ্র মন্থন করে সমুদ্রের মধ্যে যা-কিছু ছিল সমস্ত বাহির করেছিলেন । সমুদ্রদেবেরও কিছু করতে পারলেন না, অসুরেরও কিছু করতে পারলেন না, হতভাগ্য দুর্বল মানুষের উপর তার প্রতিশোধ তুলছেন । মন্দরপবর্ত কোথায় জানি নে এবং শেষ নাগ তদবধি পাতালে বিশ্রাম করছেন, কিন্তু সেই সনাতন মন্থনের ঘূর্ণিবেগ যে এখনো সমুদ্রের মধ্যে রয়ে গেছে তা