পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

vరిy রবীন্দ্র-রচনাবলী নরজঠরধারী মাত্রেই অনুভব করেন। যারা করেন না তারা বোধ করি দেবতা অথবা অসুরবংশীয় । আমার বন্ধুটিও শেষোক্ত দলের, অর্থাৎ তিনিও করেন না । রোগশয্যা ছেড়ে এখন “ডেকে উঠে বসেছি। সম্পূর্ণ বললাভ হয় নি। শরীরের এইরকম অবস্থার মধ্যে একটু মাধুর্য আছে। এই সময়ে পৃথিবীর আকাশ বাতাস সূর্যালোক সবসুদ্ধ সমস্ত বাহ্য প্রকৃতির সঙ্গে যেন একটি নূতন পরিচয় আরম্ভ হয়। তাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কিছুকালের মতো বিচ্ছিন্ন হওয়াতে আবার যেন নবপ্রেমিকের মতো উভয়ের মধ্যে মৃদু সলজ্জ মধুর ভাবে কথাবার্তা জানাশোনার অল্প অল্প সূত্রপাত হতে থাকে। ২৯ আগস্ট । আজ রাত্রে এডেনে পৌঁছব | সেখানে কাল প্ৰাতে জাহাজ বদল করতে হবে । সমুদ্রের মধ্যে দুটি-একটি করে পাহাড়-পর্বতের রেখা দেখা যাচ্ছে। জ্যোৎস্না রাত্রি । এডেন বন্দরে এসে জাহাজ থামল । আহারের পর রহস্যালাপে প্ৰবৃত্ত হবার জন্যে আমরা দুই বন্ধু ছাদের এক প্রান্তে চৌকি দুটি সংলগ্ন করে আরামে বসে আছি। নিস্তরঙ্গ সমুদ্র এবং জ্যোৎস্নাবিমুগ্ধ পর্বতবেষ্টিত তটচিত্র আমাদের আলস্য-বিজড়িত অর্ধনিমীলিত নেত্ৰে স্বপ্ন-মরীচিকার মতো লাগছে । এমন সময় শোনা গেল এখনই নূতন জাহাজে চড়তে হবে । সে জাহাজ আজ রাত্রেই ছাড়বে | ক্যাবিনের মধ্যে স্তৃপাকার বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্র যেমন-তেমন করে চর্মপেটকের মধ্যে প্রবিষ্ট করিয়ে দিয়ে যথাযোগ্য পুরস্কার দিয়ে ছোটাে বড়ো মাঝারি নানা আকারের বাক্স তোরঙ্গ বিছানাপত্র বহন করে নীেকারোহণপূর্বক নূতন জাহাজ “ম্যাসীলিয়া” অভিমুখে চললুম। অনতিদূরে মাস্তুল-কণ্টকিত ম্যাসীলিয়া তার দীপালোকিত ক্যাবিনগুলির সুদীর্ঘশ্রেণীবদ্ধ বাতায়ন উদঘাটিত করে দিয়ে পৃথিবীর আদিম কালের অতিকায় সহস্রচক্ষু জলজন্তুর মতো স্থির সমুদ্রে জ্যোৎস্নালোকে নিস্তব্ধভাবে ভাসছে। সহসা সেখান থেকে ব্যান্ড বেজে উঠল । সংগীতের ধ্বনিতে এবং নিস্তব্ধ জ্যোৎস্নানিশীথে মনে হতে লাগল, অর্ধরাত্রে এই আরবের উপকূলে আরব্য উপন্যাসের মতো কী একটা মায়ার কাণ্ড ঘটবে । ম্যাসীলিয়া অষ্ট্রেলিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে আসছে। কুতুহলী নরনারীগণ ডেকের বারান্দা ধরে সকৌতুকে নবযাত্রীসমাগম দেখছে। কিন্তু সে-রাত্রে নূতনত্ব সম্বন্ধে আমাদেরই তিনজনের সব চেয়ে জিত । বহুকষ্টে জিনিসপত্র উদ্ধার করে ডেকের উপর যখন উঠলুম মুহুর্তের মধ্যে এক জাহাজ দৃষ্টি আমাদের উপর বর্ষিত হল । যদি তার কোনো চিহ্ন দেবার ক্ষমতা থাকত তা হলে আমাদের সর্বাঙ্গ কটা কালো ও নীল ছাপে ভরে যেত। জাহাজটি প্ৰকাণ্ড । তার সংগীতশালা এবং ভোজনগৃহের ভিত্তি শ্বেতপ্ৰস্তরে মণ্ডিত । বিদ্যুতের আলো এবং ব্যান্ডের বাদ্যে উৎসবময় । অনেক রাত্রে জাহাজ ছেড়ে দিলে । ৩০ আগস্ট । আমাদের এ জাহাজে ডেকের উপরে আর-একটি দোতলা ডেকের মতো আছে । সেটি ছোটাে এবং অপেক্ষাকৃত নির্জন । সেইখানেই আমরা আশ্রয় গ্রহণ করলুম। আমার বন্ধুটি নীরব এবং অন্যমনস্ক । আমিও তদ্রুপ । দূর সমুদ্রতীরের পাহাড়গুলো রৌদ্রে ক্লান্ত এবং ঝাপসা দেখাচ্ছে । একটা মধ্যাহতন্দ্রার ছায়া পড়ে যেন অস্পষ্ট হয়ে এসেছে । খানিকটা ভাবছি, খানিকটা লিখছি, খানিকটা ছেলেদের খেলা দেখছি। এ জাহাজে অনেকগুলি ছোটাে ছোটাে ছেলেমেয়ে আছে ; আজকের দিনে যেটুকু চাঞ্চল্য সে কেবল তাদেরই মধ্যে । জুতোমোজা খুলে ফেলে তারা আমাদের ডেকের উপর কমললেবু গড়িয়ে খেলা করছে— তাদের তিনটি দাসী বেঞ্চির উপরে বসে নতমুখে নিস্তব্ধভাবে সেলাই করে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে কটাক্ষপাতে যাত্রীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। বহুদূরে এক-আধটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সমুদ্রে এক-একটা পাহাড় জেগে উঠেছে, অনুর্বর কঠিন কালো দগ্ধ তপ্ত জনশূন্য। অন্যমনস্ক প্রহরীর মতো সমুদ্রের মাঝখানে দাড়িয়ে তারা