পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br8 O রবীন্দ্র-রচনাবলী নায়িকটি উপাসনায় যোগ না দিয়ে উপরের ডেকে বসে তারই একটি উপাসক যুবকের সঙ্গে কৌতুকলাপে নিমগ্ন আছেন। মাঝে মাঝে উচ্চহাস্য করে উঠছেন, আবার মাঝে মাঝে গুন গুন স্বরে ধর্মসংগীতেও যোগ দিচ্ছেন । আজ আহারের সময় একটি নূতন সংবাদের সৃষ্টি করা গেছে। ছোটাে টেবিলটিতে আমরা তিনজনে ব্রেকফাস্ট খেতে বসেছি। একটা শক্ত গোলাকার রুটির উপরে ছুরি চালনা করতে গিয়ে ছুরিটা সবলে পিছলে আমার বাম হাতের দুই আঙুলের উপর এসে পড়ল। রক্ত চার দিকে ছিটকে পড়ে গেল । তৎক্ষণাৎ আহারে ভঙ্গ দিয়ে ক্যাবিনে পলায়ন করলুম। ইতিহাসে অনেক রক্তপাত লিপিবদ্ধ হয়েছে- আমার ডায়ারিতে আমার এই রক্তপাত লিখে রাখলুম ; ভাবী বঙ্গবীরদের কাছে গৌরবের প্রার্থী নই ; বর্তমান বঙ্গাঙ্গনাদের মধ্যে কেউ যদি একবার ‘আহা’ বলেন । ১ সেপ্টেম্বর ৷ সন্ধ্যার পর আহারান্তে উপরের ডেকে আমাদের যথাস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করা গেল ! মৃদু শীতল বায়ুতে আমার বন্ধু ঘুমিয়ে পড়েছেন এবং দাদা অলসভাবে ধূমসেবন করছেন, এমন সময় নীচের ডেকে নাচের বাজনা বেজে উঠল। সকলে মিলে জুডি জুড়ি ঘূর্ণনৃত্য আরম্ভ হল। তখন পর্ব দিকে নব কৃষ্ণপক্ষের পূর্ণপ্ৰায় চন্দ্র ধীরে ধীরে সমুদ্রশয়ন থেকে উঠে আসছে। এই তীররেখাশূন্য জলময় মহামরুর পূর্বসীমান্তে উদয়পথের ঠিক নীচে থেকে আমাদের জাহাজ পর্যন্ত অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে প্রশস্ত দীর্ঘ আলোকপথ ঝিকমিক করছে। জ্যোৎস্নাময়ী সন্ধা কোন এক অলৌকিক বৃন্তের উপরে অপূর্ব শুভ্র রজনীগন্ধার মতো আপন প্রশান্ত সৌন্দর্যে নিঃশব্দে চতুর্দিকে দলপ্রসারণ করল । আর মানুষগুলো পরস্পরকে জড়ােজড়ি করে ধরে পাগলের মতো তীব্র আমোদে ঘুরপাক খাচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ৩ সেপ্টেম্বর । বেলা দশটার সময় সুয়েজ খালের প্রবেশমুখে এসে জাহাজ থামল। চারি দিকে চমৎকার রঙের খেলা ! পাহাড়ের উপর রৌদ্র, ছায়া এবং নীলিম বাষ্প | ঘননীল সমুদ্রের প্রান্তে বালুকাতীরের রৌদ্রদুঃসহ গাঢ় পীত রেখা । খালের মধ্যে দিয়ে জাহাজ সমস্ত দিন অতি ধীর গতিতে চলছে। দু-ধারে তরুহীন বালুকা । কেবল মাঝে মাঝে এক-একটি ছোটো কোঠাঘর বহুযত্নবর্ধিত গুটিকতক গাছে-পালায় বেষ্টিত হয়ে আরাম জনক দেখাচ্ছে । অনেক রাতে আধখানা চাদ উঠল। ক্ষীণ চন্দ্রালোকে দুই তীর অস্পষ্ট ধু ধূ করছে — রাত দুটাে-তিনটের সময় জাহাজ পোর্টসৈয়েদে নোঙর করলে । ৪ সেপ্টেম্বর । এখন আমরা ভূমধ্যসাগরে, যুরোপের অধিকারের মধ্যে । বাতাসও শীতল হয়ে এসেছে, সমুদ্রও গাঢ়তর নীল । আজ রাত্রে আর ডেকের উপর শোওয়া হল না । ৫ সেপ্টেম্বর । বিকালের দিকে ক্রীট দ্বীপের তটপর্বত দেখা দিয়েছিল । ডেকের উপর একটা স্টেজ বাধা হচ্ছে । জাহাজে একদল নাট্যব্যবসায়ী যাত্রী আছে, তারা অভিনয় করবে । অন্যদিনের চেয়ে সকাল সকাল ডিনার খেয়ে নিয়ে তামাশা আরম্ভ হল । প্ৰথমে যাত্রীদের মধ্যে র্যারা গানবাজনা কিঞ্চিৎ জানেন এবং জানেন না, তাদের কারো-বা দুর্বল পিয়ানোর টিং টিং কারো-বা মৃদু ক্ষীণকণ্ঠে গান হল । তার পরে যবনিকা উদঘাটন করে নটনটী কর্তৃক ‘ব্যালোঁ নাচ, সঙ, নিগ্রোর গান, জাদু, প্রহসন, অভিনয় প্রভৃতি বিবিধ কৌতুক হয়েছিল। মধ্যে নাবিকাশ্রমের জন্যে দর্শকদের কাছ থেকে চান্দা সংগ্রহ হল। ৬ সেপ্টেম্বর । খাবার ঘরে খোলা জানলার কাছে বসে বাড়িতে চিঠি লিখছি। একবার মুখ তুলে বামে চেয়ে দেখলুম “আয়োনিয়ান’ দ্বীপ দেখা দিয়েছে। পাহাড়ের কোলের মধ্যে সমুদ্রের ঠিক ধারেই মনুষ্যরচিত। ঘনসন্নিবিষ্ট একটি শ্বেত মৌচাকের মতো দেখা যাচ্ছে। এইটি জান্তি শহর (Zanthe) { দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন পৰ্বতটা তার প্রকাণ্ড করপুটে কতকগুলো শ্বেত পুষ্প নিয়ে সমুদ্রকে অঞ্জলি দেবার উপক্রম করছে । ডেকের উপর উঠে দেখি আমরা দুই শৈলশ্রেণীর মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ সমুদ্রপথে চলেছি। আকাশে মেঘ করে এসেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে- ঝড়ের সম্ভাবনা । আমাদের সর্বোচ্চ ডেকের চাঁদোয়া