পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bi 8 SR রবীন্দ্র-রচনাবলী কাঠি পোতা, তারই উপর ফলগুচ্ছপূর্ণ দ্রাক্ষালতা লতিয়ে উঠেছে। ক্ৰমে পাহাড় দেখা দিচ্ছে। পাহাড়গুলি উপর থেকে নীচে পর্যন্ত দ্রাক্ষাদণ্ডে কণ্টকিত হয়ে উঠেছে, তারই মাঝখানে এক-একটি লোকালয় । রেলের লাইনের ধারে দ্রাক্ষাক্ষেত্রের প্রান্তে একটি ক্ষুদ্র কুটির ; এক হাতে তারই একটি দুয়ার ধরে । এক হাত কোমরে দিয়ে একটি ইতালিয়ান যুবতী সকৌতুক কৃষ্ণনেত্রে আমাদের গাড়ির গতি নিরীক্ষণ করছে। অনতিদূরে একটি বালিকা একটা প্রখরশুঙ্গ প্রকাণ্ড গােরুর গলার দড়িটি ধরে নিশ্চিন্তমনে চরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তার থেকে আমাদের বাংলা দেশের নবদম্পতির চিত্ৰ মনে পড়ল। মস্ত একটা চশমা-পরা গ্রাজুয়েট-পুংগব, এবং তারই দড়িটা ধরে ছোটাে একটি চোদ-পনেরো বৎসরের নোলক-পরা নববধু ; জন্তুটি দিব্যি পোষ মেনে চরে বেড়াচ্ছে, এবং মাঝে মাঝে বিস্ফারিতনয়নে কত্রীর | প্রতি দৃষ্টিপাত করছে। টুরিন স্টেশনে আসা গেল। এ দেশের সামান্য পুলিসম্যানের সাজ দেখে অবাক হতে হয় | মস্ত চূড়াওয়ালা টুপি, বিস্তর জড়িজড়াও, লম্বা তলোয়ার— সকল ক'টিকেই সম্রাটের জ্যেষ্ঠপুত্র বলে মনে হয় । দক্ষিণে বামে তুষাররেখাঙ্কিত সুনীল পর্বতশ্রেণী । বামে ঘনচ্ছায়াস্নিগ্ধ অরণ্য। যেখানে অরণ্যের একটু বিচ্ছেন্দ পাওয়া যাচ্ছে সেইখানেই শস্যক্ষেত্র তরুশ্রেণী ও পর্বত-সমেত এক-একটা নব নব আশ্চর্য দৃশ্য খুলে যাচ্ছে। পর্বতশৃঙ্গের উপর পুরাতন দুৰ্গশিখর, তলদেশে এক-একটি ছোটাে ছোটাে গ্ৰাম । যত এগোচ্ছি অরণ্যপর্বত ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে । মাঝে মাঝে যে গ্রামগুলি আসছে সেগুলি তেমন উদ্ধত শুভ্ৰ নবীন পরিপাটি নয় ; একটু যেন স্নান দরিদ্র নিভৃত ; একটি-আধটি চার্চের চুড়া আছে মাত্র ; কিন্তু কল-কারখানার ধূমোদাগারী বৃংহিতধ্বনিত উর্ধর্বমুখ ইষ্টকশুণ্ড নেই। ক্ৰমে অল্পে অল্পে পাহাড়ের উপর ওঠা যাচ্ছে। পার্বত্য পথ সাপের মতো একেবেঁকে চলেছে ; ঢালু। পাহাড়ের উপর চাষা খেত সোপানের মতো থাকে থাকে উঠেছে। একটি গিরিনদী স্বচ্ছ সফেন জলরাশি নিয়ে সংকীর্ণ উপলপথ দিয়ে ঝরে পড়ছে। গাড়িতে আলো দিয়ে গেল। এখনই মণ্ট সেনিসের বিখ্যাত দীর্ঘ রেলোয়ে-সুরঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে । গহবরটি উত্তীর্ণ হতে প্ৰায় আধঘণ্টা লাগল । এইবার ফ্রান্স । দক্ষিণে এক জলস্রোত ফেনিয়ে ফেনিয়ে চলেছে। ফরাসি জাতির মতো দ্রুত চঞ্চল উচ্ছসিত হাস্যপ্রিয় কলাভাষী । ফ্রান্সের প্রবেশদ্বারে একবার একজন কর্মচারী গাড়িতে এসে জিজ্ঞাসা করে গেল আমাদের মাসুল দেবার যোগ্য জিনিস কিছু আছে কি না । আমরা বললুম, না। আমাদের একজন বৃদ্ধ সহযাত্রী ইংরেজ <GiGirl, I don't parlez-vous francaise সেই স্রোত এখনো আমাদের ডান দিক দিয়ে চলেছে। তার পূর্ব তীরে “ফার অরণ্য নিয়ে পাহাড় দাড়িয়ে আছে। চঞ্চলা নিঝরিণী বেঁকেচুরে ফেনিয়ে ফুলে নেচে কলরব করে পাথরগুলোকে সর্বাঙ্গ দিয়ে ঠেলে রেলগাড়ির সঙ্গে সমান দৌড় দিয়েছে। মাঝে মাঝে এক-একটা লোহার সাকো মুষ্টি দিয়ে তার ক্ষীণ কটিদেশ পরিমাপ করবার চেষ্টা করছে। এক জায়গায় জলরাশি খুব সংকীর্ণ ; দুই তীরের শ্রেণীবদ্ধ দীর্ঘ বৃক্ষগুলি শাখায় শাখায় বেষ্টন করে দুরন্ত স্রোতকে অন্তঃপুরে বন্দী করতে বৃথা চেষ্টা করছে। উপর থেকে ঝরনা এসে সেই প্রবাহের সঙ্গে মিশছে। বরাবর পূর্ব তীর দিয়ে একটি পার্বত্য পথ সমরেখায় স্রোতের সঙ্গে বেঁকে চলে গেছে । এক জায়গায় আমাদের সহচরীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হল । হঠাৎ সে দক্ষিণ থেকে বামে এসে এক অজ্ঞাত সংকীর্ণ শৈলপথে অন্তহিঁত হয়ে গেল । শ্যামল তৃণাচ্ছন্ন পর্বতশ্রেণীর মধ্যে এক-একটা পাহাড় তৃণহীন সহস্ৰ-রেখাঙ্কিত পাষাণ-কঙ্কাল প্রকাশ করে নগ্নভাবে দাড়িয়ে আছে ; কেবল তার মাঝে মাঝে এক-এক জায়গায় খানিকটা করে অরণ্যের খণ্ড আবরণ রয়েছে। প্ৰচণ্ড সংগ্রামে একটা দৈত্য সহস্ৰ সহস্ৰ হিংস্ৰ নখের বিদারণরেখা রেখে যেন ওর শ্যামল ত্বক অনেকখানি করে আঁচড়ে ছিড়ে নিয়েছে ।