পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br8\ኃ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অসংগত লম্বা ধুচুনি টুপি পরি নে, তবে হাস কী দেখে ? আমি সুশ্ৰী কি কুশ্ৰী সে-বিষয়ে কোনাে প্রসঙ্গ উত্থাপন করা রুচিবিরুদ্ধ কিন্তু এটা আমি জোর করে বলতে পারি বিদ্রুপের তুলি দিয়ে বিধাতাপুরুষ আমার মুখমণ্ডল অঙ্কিত করেন নি। তবে যদি রঙটা কালো এবং চুলগুলো কিছু লম্বা দেখে হাসি পায়, তা হলে এই পর্যন্ত বলতে পারি, প্রকৃতিভেদে হাস্যরস সম্বন্ধে অদ্ভুত রুচিভেদ লক্ষিত হয়। তোমরা যাকে ‘হিউমার’ বল, আমার মতে কালো রঙের সঙ্গে তার কোনো কার্যকরণ-সম্বন্ধ নেই। দেখছি বটে, তোমাদের দেশে মুখে কালি মেখে কাফ্রি সেজে নৃত্যগীত করা একটা কৌতুকের মধ্যে গণ্য হয়ে থাকে । কিন্তু, কনককেশিনি, সেটা আমার কাছে নিতান্ত হৃদয়হীন বর্বরতা বলে বোধ হয় ।” ২২ সেপ্টেম্বর । আজ সন্ধ্যার সময় গোটাকতক বাংলা গান গাওয়া গেল। তার মধ্যে গুটি দুই-তিন এখানকার শ্রোত্রীগণ বিশেষ পছন্দ করেছেন । আশা করি, সেটা কেবলমাত্র মৌখিক ভদ্রতা নয় । তবে চাণক্য বলেছেন- ইত্যাদি । ২৩ সেপ্টেম্বর । আজকাল সমস্ত দিনই প্ৰায় জিনিসপত্র কিনে দোকানে দোকানে ঘুরে কেটে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরে এলেই আমার বন্ধু বলেন, এসো বিশ্রাম করি গে। তার পরে খুব সমারোহে বিশ্রাম করতে যাই। শয়নগৃহে প্ৰবেশ করে বান্ধবটি অনতিবিলম্বে শয্যাতল আশ্রয় করেন, আমি পার্শ্ববতী একটি সুগভীর কেদারার মধ্যে নিমগ্ন হয়ে বসি । তার পরে, কোনো বিদেশী কাব্যগ্রন্থ পাঠ করি, না-হয়, দুজনে মিলে জগতের যত-কিছু অতলস্পর্শ বিষয় আছে দেখতে দেখতে তার মধ্যে তলিয়ে অন্তর্ধান করি । আজকাল এইভাবে এতই অধিক বিশ্রাম করছি যে, কাজের অবকাশ তিলমাত্র থাকে না । ড্রয়িংরুমে ভদ্রলোকেরা গীতবাদ্য সদালাপ করেন, আমরা তার সময় পাই নে, আমরা বিশ্রামে নিযুক্ত । শরীররক্ষার জন্যে সকলে কিয়ৎকাল মুক্ত বায়ুতে ভ্ৰমণাদি করে থাকেন, সে হতেও আমরা বঞ্চিত, আমরা এত অধিক বিশ্রাম করে থাকি । রাত দুটাে বাজল, আলো নিবিয়ে দিয়ে সকলেই আরামে নিদ্ৰা দিচ্ছে, কেবল আমাদের দুই হতভাগ্যের ঘুমোবার অবসর নেই, আমরা তখনো অত্যন্ত দুরূহ বিশ্রামে ব্যস্ত । ২৫ সেপ্টেম্বর । আজ এখানকার একটি ছোটােখাটাে একসিবিশনি দেখতে গিয়েছিলুম। শুনলুম এটা প্যারিস একসিবিশনের অত্যন্ত সুলভ এবং সংক্ষিপ্ত দ্বিতীয় সংস্করণ । সেখানে চিত্রশালায় প্রবেশ করে কারোলু ডুরা –নামক একজন বিখ্যাত ফরাসী চিত্রকর-রচিত একটি বসনহীনা মানবীর ছবি দেখলুম। আমরা প্রকৃতির সকল শোভাই দেখি, কিন্তু মর্তের এই চরম সৌন্দর্যের উপর, জীব-অভিব্যক্তির এই সর্বশেষ কীর্তিখানির উপর, মানুষ স্বহস্তে একটি চির-অন্তরাল টেনে রেখে দিয়েছে। এই দেহখানির স্নিগ্ধ শুভ্ৰ কোমলতা এবং প্রত্যেক সুঠাম সুনিপুণ ভঙ্গিমার উপরে অসীম সুন্দরের সযত্ন অঙ্গুলির সদ্যস্পর্শ দেখা যায় যেন । এ কেবলমাত্র দেহের সৌন্দর্য নয়, যদিও দেহের সৌন্দর্য যে বড়ো সামান্য এবং সাধুজনের উপেক্ষণীয় তা বলতে পারি নে— কিন্তু এতে আরো অনেকখানি গভীরতা আছে। একটি গ্ৰীতিরমুণীয় সুকোমল নারী-প্রকৃতি, একটি অমরসুন্দর মানবাত্মা এর মধ্যে বাস করে, তারই দিব্য লাবণ্য এর সর্বত্র উদভাসিত। দূর থেকে চকিতের মতো সেই অনির্বচনীয় চির-রহস্যকে দেহের স্ফটিক-বাতায়নে একটুখানি যেন দেখা গেল । ২৭ সেপ্টেম্বর । আজ লাইসীয়ম নাট্যশালায় গিয়েছিলুম। স্কট-রচিত ‘ব্রাইড অফ লামারমুর উপন্যাস নাট্যাকারে অভিনীত হয়েছিল । বিখ্যাত অভিনেতা আর্ভিং নায়ক সেজেছিলেন । তার উচ্চারণ অস্পষ্ট এবং অঙ্গভঙ্গি অদ্ভূত। তৎসত্ত্বেও তিনি কী এক নাট্যকৌশলে ক্রমশ দর্শকদের হৃদয়ে সম্পূর্ণ আধিপত্য স্থাপন করতে পারেন। আমাদের সম্মুখবর্তী একটি বাক্সে দুটি মেয়ে বসে ছিল। তার মধ্যে একটি মেয়ের মুখ রঙ্গভূমির সমস্ত দর্শকের চিত্ত এবং দূরবীন আকৃষ্ট করেছিল। নিখুঁত সুন্দর ছােটাে মুখখানি, অল্প বয়স, দীর্ঘ বেণী পিঠে ঝুলছে, বেশভুষার আড়ম্বর নেই। অভিনয়ের সময় যখন সমস্ত আলো নিবিয়ে দিয়ে কেবল স্টেজের আলো জ্বলছিল এবং সেই আলো স্টেজের অনতিদূরবতী তার আধখানি মুখের উপর এসে পড়েছিল— তখন তার আলোকিত সুকুমার মুখের রেখা এবং সুভঙ্গিম গ্ৰীবা অন্ধকারের উপর