পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি 8૧ চমৎকার চিত্র রচনা করেছিল। হিতৈষীরা আমাকে পুনশ্চ মার্জনা করবেন— অভিনয়কালে সে দিকে আমার দৃষ্টি বদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু দূরবীন কষাটা আমার আসে না। নির্লজ্জ স্পর্ধার সহিত পরস্পরের প্রতি অসংকোচে দূরবীন প্রয়োগ করা নিতান্ত রূঢ় মনে হয়। ২ অক্টোবর। একটি গুজরাটির সঙ্গে দেখা হল। ইনি ভারতবর্ষ থেকে সমস্ত পথ জাহাজের ডেকে চড়ে এসেছেন। তখন শীতের সময় । মাছ-মাংস খান না। সঙ্গে চিড়ে শুষ্কফল প্রভৃতি কিছু ছিল এবং জাহাজ থেকে শাকসবজি কিছু সংগ্রহ করতেন। ইংরেজি অতি সামান্য জানেন । গায়ে শীতবস্ত্র অধিক নেই । লন্ডনে স্থানে স্থানে উদ্ভিজ ভোজনের ভোজনশালা আছে, সেখানে ছয় পেনিতে তার আহার সমাধা হয় । যেখানে যা-কিছু দ্রষ্টব্য জ্ঞাতব্য বিষয় আছে সমস্ত অনুসন্ধান করে বেড়ান। বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে অসংকোচে সাক্ষাৎ করেন । কী রকম করে কথাবার্তা চলে বলা শক্ত | মধ্যে মধ্যে কার্ডিনাল ম্যানিঙের সঙ্গে ধর্মালোচনা করে আসেন। ইতিমধ্যে একসিবিশনের সময় প্যারিসে দুই মাস য়াপন করে এসেছেন এবং অবসরমত আমেরিকায় যাবার সংকল্প করছেন । ভারতবর্ষে ঐকে আমি জানতুম । ইনি বাংলা শিক্ষা করে অনেক ভালো বাংলা বই গুজরাটিতে তরজমা করেছেন। এর স্ত্রী-পুত্র পরিবার কিছুই নেই। ভ্ৰমণ করা, শিক্ষা করা, এবং স্বদেশীয় সাহিত্যের উন্নতি সাধন করা এর একমাত্র কাজ। লোকটি অতি নিরীহ শীর্ণ, খর্ব, পৃথিবীতে অতি অল্প পরিমাণ স্থান অধিকার করেন । একে দেখে আমার আশ্চর্য বোধ হয় । ৬ অক্টোবর । এখনো আমাদের প্রবাসের সময় উত্তীর্ণ হয় নি, কিন্তু আমি আর এখানে পেরে উঠছি নে । বলতে লজা বোধ হয়, আমার এখানে ভালো লাগছে না । সেটা গর্বের বিষয় নয়, লজার বিষয়- সেটা আমার স্বভাবের ত্রুটি । যখন কৈফিয়ত সন্ধান করি তখন মনে হয় যে, যুরোপের যে ভাবটা আমাদের মনে জাজ্বল্যমান হয়ে উঠেছে, সেটা সেখানকার সাহিত্য ইতিহাস পড়ে । সেটা হচ্ছে আইডিয়ােল যুরোপ । অন্তরের মধ্যে প্ৰবেশ করলে সেটা প্ৰত্যক্ষ করবার জো নেই । তিন-মাস, ছ-মাস কিংবা ছ-বৎসর এখানে থেকে আমরা যুরোপীয় সভ্যতার কেবল হাত-পা নাড়া দেখতে পাই মাত্র । বড়ো বড়ো বাড়ি, বড়ো বড়ো কারখানা, নানা আমোদের জায়গা ; লোক চলছে ফিরছে, যাচ্ছে আসছে, খুব একটা সমারোহ। সে যতই বিচিত্র, যতই আশ্চর্য হােক-না কেন, তাতে দর্শককে শ্রান্তি দেয় ; কেবলমাত্র বিস্ময়ের উত্তেজনা চিত্তকে পরিপূর্ণ করতে পারে না। বরং তাতে মনকে সর্বদা বিক্ষিপ্ত করতে থাকে । অবশেষে এই কথা মনে আসে— আচ্ছা ভালো রে বাপু, আমি মেনে নিচ্ছি। তুমি মস্ত শহর, মস্ত দেশ, তোমার ক্ষমতা এবং ঐশ্বর্যের সীমা নেই। অধিক প্রমাণের আবশ্যকতা নেই। এখন আমি বাড়ি যেতে পারলে বাচি । সেখানে আমি সকলকে চিনি, সকলকে বুঝি ; সেখানে সমস্ত বাহ্যাবরণ ভেদ করে মনুষ্যত্বের আস্বাদ সহজে পাই । সহজে উপভোগ করতে পারি, সহজে চিন্তা করতে পারি, সহজে ভালোবাসতে পারি। যেখানে আসল মানুষটি আছে সেখানে যদি অবাধে যেতে পারতুম, তা হলে বিদেশেও আপনার স্বজাতীয়কে দেখে এ স্থানকে আর প্রবাস বলে মনে হত না । কিন্তু এখানে এসে দেখি কেবল ইংরেজ, কেবল বিদেশী, তাদের চালচলন ধরনধারণ যা-কিছু নূতন সেইটেই কেবল ক্ৰমিক চক্ষে পড়ে, যা চিরকেলে পুরাতন সেটা ঢাকা পড়ে থাকে ; সেইজন্যে এদের সঙ্গে কেবল পরিচয় হতে থাকে। কিন্তু প্ৰণয় হয় না । এইখানে কথামালার একটা গল্প মনে পড়ছে। একটা চতুর শৃগাল একদিন এক সুবিজ্ঞ বককে আহারে নিমন্ত্রণ করেছিল । বাক সভায় গিয়ে দেখে বড়ো বড়ো থালা সুমিষ্ট লেহ্য পদার্থে পরিপূর্ণ। প্রথম শিষ্ট-সম্ভাষণের পর শৃগাল বললে, “ভাই, এসো আরম্ভ করে দেওয়া যাক ৷” বলেই তৎক্ষণাৎ অবলীলাক্রমে লেহন করতে প্ৰবৃত্ত হল । বিক তার দীর্ঘ চষ্ণু নিয়ে থালার মধ্যে যতই ঠোকর মারে মুখে কিছুই তুলতে পারে না। অবশেষে চেষ্টায় নিবৃত্ত হয়ে স্বাভাবিক অটল গাম্ভীর্যে সরোবরকুলের ধ্যানে নিমগ্ন হল । শৃগাল বোধ করি মাঝে মাঝে কটাক্ষপাত করে বলছিল, “ভাই, খােচ্ছ না যে । এ কেবল তোমাকে মিথ্যা কষ্ট দেওয়াই হল । তোমার যোগ্য