পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

σΟ Ο রবীন্দ্র-রচনাবলী উদার দুর্বলবৎসলতা থেকে স্ত্রীলোকের সেবা করে থাকে ; যে দেশে স্ত্রীলোকেরা সেই সেবা পায় না, কেবল সেবা করে, সে দেশে তারা অপমানিত এবং সে দেশও লক্ষ্মীছাড়া । কিন্তু কথাটা হচ্ছিল স্ত্রীলোকের দৌরাত্ম্য সম্বন্ধে । গোলাপের যে-কারণে কাটা থাকা আবশ্যক, যেখানে স্ত্রী পুরুষে বিচ্ছেদ নেই। সেখানে স্ত্রীলোকেরও সেই কারণে প্রখরতা থাকা চাই, তীক্ষ কথায় মৰ্মচ্ছেদ করবার অভ্যাস অবলার পক্ষে অনেক সময়েই কাজে লাগে । আমাদের গোলাপগুলিই কি একেবারে নিষ্কণ্টক ? কিন্তু সে-বিষয়ে সমধিক সমালোচনা করতে বিরত থাকা গেল । ১৪ অক্টোবর । জিব্রাল্টার পৌছনো গেল। মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। আজ ডিনার-টেবিলে একটা মোটা আঙুল এবং ফুলো গোফওআলা। প্রকাণ্ড জোয়ান গোরা তার সুন্দরী পার্শ্ববর্তিনীর সঙ্গে ভারতবর্ষীয় পাখাওআলার গল্প করছিল । সুন্দরী কিঞ্চিৎ নালিশের নাকিস্বরে বললেন- পাখাওআলারা রাত্রে পাখা টানতে টানতে ঘুমোয় । জোয়ান লোকটা বললে, তার একমাত্র প্ৰতিবিধান লাথি কিংবা লাঠি । পাখা-আন্দোলন সম্বন্ধে এইভাবে আন্দোলন চলতে লাগিল । আমার বুকে হঠাৎ যেন একটা তপ্ত শূল বিধল । এইভাবে যারা স্ত্রীপুরুষে কথোপকথন করে তারা যে অকাতরে এক সময় একটা দিশি দুর্বল মানব-বিড়ম্বনাকে ভবপারে লাথিয়ে ফেলে দেবে তার আর বিচিত্র কী ? আমিও তো সেই অপমানিত জাতের লোক, আমি কোন লজ্জায় কোন সুখে এদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাই এবং একত্রে দন্তোমীলন করি । শরীরের সমস্ত রাগ। কণ্ঠ পর্যন্ত এল কিন্তু একটা কথাও বহু চেষ্টাতে সে-জায়গায় এসে পৌঁছল না । বিশেষত ওদের ঐ ইংরেজি ভাষাটা বড়োই বিজাতীয়— মনটা একটু বিচলিত হয়ে গেলেই ও-ভাষাটা মনের মতো কায়দা করে উঠতে পারি। নে ? তখন মাথার চতুর্দিক হতে রাজ্যের বাংলা কথা চাকি-নাড়া মৌমাছির মতো মুখাদ্ধারে ভিড় করে ছুটে আসে । ভাবলুম এত উতলা হয়ে উঠলে চলবে না, একটু ঠাণ্ডা হয়ে দুটাে-চারটে ব্যাকরণ শুদ্ধ ইংরেজি কথা মাথার মধ্যে গুছিয়ে নিই। ঝগড়া করতে গেলে নিদেন ভাষাটা ভালো হওয়া চাই । তখন মনে মনে নিম্নলিখিত মতো ভাবটা ইংরেজিতে রচনা করতে লাগলম : কথাটা ঠিক বটে। মশায়, পাখাওআলা মাঝে মাঝে রাত্রে ঢুললে অত্যন্ত অসুবিধা হয় ৷ দেহধারণ করলেই এমন কতকগুলো সহ্য করতে হয় এবং সেইজন্যই খৃস্টীয় সহিষ্ণুতার প্রয়োজন ঘটে । এবং এইরূপ সময়েই ভদ্রাভদ্রের পরিচয় পাওয়া যায় । যে লোক তোমার আঘাতের প্রতিশোধ নিতে একেবারেই অক্ষম, খপ করে তার উপরে লাথি তোলা চূড়ান্ত কাপুরুষতা ; অভদ্রতার চেয়ে বেশি। আমরা জাতটা যে তোমাদের চেয়ে দুর্বল সেটা একটা প্ৰাকৃতিক সত্য— সে আমাদের অস্বীকার করবার জো নেই | তোমাদের গায়ের জোর বডেড়া বেশি- তোমরা ভারি পালোয়ান । কিন্তু সেইটেই কি এত গর্বের বিষয় যে, মনুষ্যত্বকে তার নীচে আসন দেওয়া হবে ? তোমরা বলবে- কেন, আমাদের আর কি কোনো শ্রেষ্ঠতা নেই ? থাকতেও পারে । তবে, যখন একজন অস্থিজর্জর অর্ধ-উপবাসী দরিদ্রের রিক্ত উদরের উপর লাথি বসিয়ে দাও এবং তৎসম্বন্ধে রমণীদের সঙ্গে কৌতুকলাপ কর এবং সুকুমারীগণও তাতে বিশেষ বেদনা অনুভব করেন না, তখন কিছুতেই তোমাদের শ্রেষ্ঠ বলে ঠাহর করা যায় না। বেচারার অপরাধ কী দেখা যাক । ভোরের বেলা অর্ধাশনে বেরিয়েছে, সমস্ত দিন খেটেছে । হতভাগা আর দুটাে পয়সা বেশি উপার্জন করবার আশায় রাত্রের বিশ্রামটা তোমাকে দু-চার আনায় ক্রি করেছে। নিতান্ত গরিব বলেই তার এই ব্যবসায় বড়োসাহেবকে ঠকাবার জন্যে সে ষড়যন্ত্র করে এই ব্যক্তি রাত্রে পাখা টানতে টানতে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে- এ দোষটা তার আছে বলতেই হবে । কিন্তু আমার বোধ হয় এটা মানবজাতির একটি আদিম পাপের ফল । যন্ত্রের মতো বসে বসে পাখী ।