পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি V brQ> টানতে গেলেই আদমের সন্তানের চোখে ঘুম আসবেই । সাহেব নিজে একবার পরীক্ষা করে দেখতে পারেন । 4. এক ভূত্যের দ্বারা কাজ না পেলে দ্বিতীয় ভূত্য রাখা যেতে পারে, কিন্তু যে কাপুরুষ তাকে লাথি মারে সে নিজেকে অপমান করে, কারণ তখনই তার একটি প্ৰতিলাথি প্ৰাপ্য হয়- সেটা প্রয়োগ করবার লোক কেউ হাতের কাছে উপস্থিত নেই, এইটুকুমাত্র প্রভেদ । তোমরা অবসর পেলেই আমাদের বলে থাক যে, তোমাদের মধ্যে যখন বাল্যবিবাহ প্ৰভৃতি সামাজিক কুপ্ৰথা প্রচলিত তখন তােমরা রােজ্যাতন্ত্রের মধ্যে কোনাে স্বাধীন অধিকার প্রাপ্তির যোগ্য օNՑ | কিন্তু তার চেয়ে এ কথা সত্য যে, যে-জাত নিরাপদ দেখে দুৰ্ব্বলের কাছে “তেরিয়া’- অর্থাৎ তোমরা যাকে বলে “বুলি — যার কোনো বাংলা প্ৰতিশব্দ নেই- অপ্ৰিয় অশিষ্ট ব্যবহার যাদের স্বভাবত আসে, কেবল স্বার্থের স্থলে যারা নম্রভাব ধারণ করে, তারা কোনো বিদেশী রাজ্যশাসনের যোগ্য নয় । অবশ্য যোগ্যতা দুরকমের আছে— ধর্মত এবং কার্যত । এমন কতকগুলি স্থল আছে যেখানে শুদ্ধমাত্র কৃতকারিতাই যোগ্যতার প্রমাণ নয়। গায়ের জোর থাকলে অনেক কাজই বলপূর্বক চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু বিশেয বিশেষ কাজে বিশেষ বিশেষ উপযোগী নৈতিক গুণের দ্বারাই সে কাৰ্যবহনের প্রকৃত অধিকার পাওয়া যায় । কিন্তু ধর্মের শাসন সদ্য সদ্য দেখা যায় না বলে যে ধর্মের রাজ্য অরাজক তা বলা যায় না। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিষ্ঠুরতা এবং প্রতিদিনের ঔদ্ধত্য প্রতিদিন সঞ্চিত হচ্ছে, এক সময় এরা তোমাদেরই মাথায় (ङ८७ °ज्छ6द । যদি বা আমরা সকল অপমানই নীরবে অথবা কথঞ্চিৎ-কলরব-সহকারে সহ্য করে যাই, প্ৰতিকারের কোনো ক্ষমতাই যদি আমাদের না থাকে, তবু তোমাদের মঙ্গল হবে না । কারণ, অপ্রতিহত ক্ষমতার দম্ভ জাতীয় চরিত্রের মূল আক্রমণ করে । যে স্বাধীনতাপ্রিয়তার ভিত্তির উপর তোমাদের জাতীয় গৌরব প্রতিষ্ঠিত, তলে তলে সেই স্বাধীনতাপ্রিয়তার বিশুদ্ধতা নষ্ট করে । সেইজন্য ইংলন্ডবাসী ইংরেজের কাছে শোনা যায়। ভারতবর্ষীয় ইংরেজ একটা জাতিই স্বতন্ত্র । কেবলমাত্র বিকৃত যকৃৎই তার একমাত্র কারণ নয়, যকৃতের চেয়ে মানুষের আরো উচ্চতর অন্তরিান্দ্ৰিয় আছে, সেটাও নষ্ট হয়ে যায় । কিন্তু আমার এই বিভীষিকায় কেউ ডির্যাবে না । যার দ্বারে অগল নেই সেই অগত্যা চোরকে সাধুভাবে ধর্মোপদেশ দিতে বসে ; যেন চোরের পরকালের হিতের জন্যই তার রাত্রে ঘুম হয় না । লাথির পরিবর্তে উপদেশ দেওয়া এবং ধর্মভয় দেখানাে যদিচ দেখতে অতি মনােহর বটে। কিন্তু লাথির পরিবর্তে লাথি দিলেই ফলটা অতি শীঘ পাওয়া যায়। এই পুরাতন সত্যটি আমাদের জানা আছে, কিন্তু বিধাতা আমাদের সমস্ত শরীরমনের মধ্যে কেবল রসনার অগ্রভাগটুকুতে বলসঞ্চার করেছেন । সুতরাং হে জোয়ান, কিঞ্চিৎ নীতিকথা শোনো । শোনা যায়। ভারতবষীয়ের পিলে যন্ত্রটাই কিছু খারাপ হয়ে আছে, এইজন্য তারা পেটের উপরে ইংরেজ প্রভুর নিতান্ত “পেটার্নাল ট্রিটমেন্ট’-টুকুরও ভর সইতে পারে না । কিন্তু ইংরেজের পিলে কী রকম অবস্থায় আছে এ পর্যন্ত কার্যত তার কোনো পরীক্ষাই হয় নি । কিন্তু সে নিয়ে কথা হচ্ছে না ; পিলে ফেটে যে আমাদের অপঘাতমূতি্যু হয় সেটা আমাদের ললাটের লিখন । কিন্তু তার পরেই সমস্ত ব্যাপারটা তোমরা যে-রকম তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাও, তাতেই আমাদের সমস্ত জাতিকে অপমান করা হয় । তাতেই একরকম করে বলা হয় যে, আমাদের তোমরা মানুষ জ্ঞান কর না । আমাদের দুটাে-চারটে মানুষ যে খামক তোমাদের চরণতলে বিলুপ্ত হয়ে যায় সে আমাদের পিলের দোষ । “পিলে যদি ঠিক থাকত তা হলে লাথিও খেতে, বেঁচেও থাকতে এবং পুনশ্চ দ্বিতীয়বার খাবার অবসর পেতে ।”