পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি br(፩ (፩ আছি। কিছুক্ষণ বাদে বিরলকেশ পৃথুকলেবর দ্বিতীয় ব্যক্তি তোয়ালে এবং স্পঞ্জ হস্তে উপস্থিত । ঘর খালাস হবামাত্র সেই জন-বুল অমানবদনে প্ৰথমাগত আমাকে অতিক্রম করে ঘরে প্রবেশ করলে । প্রথমেই মনে হল তাকে ঠেলেঠলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ি, কিন্তু শারীরিক দ্বন্দ্বটা অত্যন্ত হীন এবং রূঢ় বলে মনে হয়, বেশ স্বাভাবিকরূপে আসে না । সুতরাং অধিকার ছেড়ে দিয়ে অবাক হয়ে দাড়িয়ে ভাবলুম, নম্রতা গুণটা খুব ভালো হতে পারে। কিন্তু খৃস্টজন্মের উনবিংশ শতাব্দী পরেও এই পৃথিবীর পক্ষে অনুপযোগী এবং দেখতে অনেকটা ভীরুতার মতো । এ ক্ষেত্রে নাবার ঘরে প্রবেশ করতে যতটা জেদের ততটা সংগ্রামের দরকার ছিল না। কিন্তু প্ৰাতঃকালেই একটা মাংসবহুল কপিশবর্ণপিঙ্গলচক্ষু রূঢ় ব্যক্তির সঙ্গে সংঘর্ষ-সম্ভাবনাটা কেমন সংকোচজনক মনে হল । স্বার্থোদ্যম জয়লাভ করে, বলিষ্ঠ বলে নয়, অতিমাংসগ্রস্ত কুৎসিত বলে । ২৬ অক্টোবর | জাহাজের একটা দিন বৰ্ণনা করা যাক । সকালে ডেক ধুয়ে গেছে, এখনো ভিজে রয়েছে। দুই ধারে ডেকচেয়ার বিশৃঙ্খল ভাবে পরস্পরের উপর রাশীকৃত । খালিপায়ে রাত-কাপড়-পরা পুরুষগণ কেউ বা বন্ধু-সঙ্গে কেউ বা একলা মধ্যপথ দিয়ে হুহু করে বেড়াচ্ছে । ক্রমে যখন আটটা বাজল এবং একটি-আধটি করে মেয়ে উপরে উঠতে লাগল। তখন একে একে এই বিরলবেশ পুরুষদের অন্তর্ধান । স্নানের ঘরের সম্মুখে বিষম ভিড় । তিনটি মাত্ৰ স্নানাগার। আমরা অনেকগুলি দ্বারস্থ । তোয়ালে এবং স্পঞ্জ হাতে দ্বারমোচনের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছি । দশ মিনিটের অধিক স্নানের ঘর অধিকার করবার নিয়ম নেই । স্নান এবং বেশভূষা সমাপনের পর উপরে গিয়ে দেখা যায় ডেকের উপর পদচারণশীল প্রভাতবায়ুসেবী অনেকগুলি স্ত্রীপুরুষের সমাগম হয়েছে। ঘন ঘন টুপি উদঘাটন করে মহিলাদের এবং শিরঃকম্পে পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে শুভাপ্রভাত অভিবাদন করে গ্ৰীষ্মের তারতম্য সম্বন্ধে পরস্পরের মত ব্যক্ত করা গেল । নটার ঘণ্টা বাজল । ব্রেকফাস্ট প্রস্তুত ; বুভুক্ষু নরনারীগণ সোপান-পথ দিয়ে নিম্নকক্ষে ভোজনবিবরে প্রবেশ করলে | ডেকের উপরে আর জনপ্রাণী অবশিষ্ট নেই, কেবল সারি সারি শূন্য চৌকি উর্ধবমুখে প্ৰভুদের জন্য প্রতীক্ষমাণ । ভোজনশালা প্ৰকাণ্ড ঘর । মাঝে দুই সার লম্বা টেবিল ; এবং তার দুই পার্থে খণ্ড খণ্ড ছোটাে ছোটাে টেবিল। আমরা দক্ষিণ পার্থে একটি ক্ষুদ্র টেবিল অধিকার করে সাতটি প্রাণী দিনের মধ্যে তিনবার ক্ষুধা নিবৃত্ত করে থাকি । মাংস রুটি ফলমূল মিষ্টান্ন মদিরায় এবং হাস্যকৌতুক গল্পগুজবে এই অনাতি-উচ্চ সুপ্ৰশস্ত ঘর কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আহারের পর উপরে গিয়ে যে যার নিজ নিজ চৌকি অন্বেষণ এবং সেটা যথাস্থানে স্থাপনে ব্যস্ত । চৌকি খুঁজে পাওয়া দায় । ডেক ধোবার সময় কার চৌকি কোথায় ফেলেছে তার ঠিক নেই। তার পর যেখানে একটু কোণ, যেখানে একটু বাতাস, যেখানে একটু রোদের তেজ কম, যেখানে যার অভ্যাস, সেইখানে ঠেলেঠলে টেনেন্টুনে পাশ কাটিয়ে পথ করে আপনার চোকিটি রাখতে পারলে সমস্ত দিনের মতো নিশ্চিন্ত । দেখা যায় কোনো চৌকিহারা স্নানমুখী রমণী কাতরভাবে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করছে, কিংবা কোনো বিপদগ্ৰস্ত অবলা এই চৌকি-অরণ্যের মধ্যে থেকে নিজেরটি বিশ্লিষ্ট করে নিয়ে অভিপ্ৰেত স্থানে স্থাপন করতে পারছে না— তখন পুরুষগণ নারীসহায়ব্ৰতে চৌকি-উদ্ধারকার্যে নিযুক্ত হয়ে সুশিষ্ট ও সুমিষ্ট ধন্যবাদ অর্জন করে থাকে । তার পর যে যার চৌকি অধিকার করে বসে যাওয়া যায়। ধূমসেবিগণ, হয়। ধূম-সেবনকক্ষে নয় ডেকের পশ্চাদভাগে সমবেত হয়ে পরিতৃপ্তমনে ধূমপান করছে। মেয়েরা অর্ধনিলীন অবস্থায় কেউ বা নভেল পড়ছে, কেউ বা সেলাই করছে, মাঝে মাঝে দুই-একজন যুবক ক্ষণেকের জন্যে পাশে বসে মধুকরের মতো কানের কাছে গুনগুন করে আবার চলে যাচ্ছে।