পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

vee রবীন্দ্র-রচনাবলী আহার কিঞ্চিৎ পরিপাক হবামাত্র এক দলের মধ্যে কয়েটস খেলা আরম্ভ হল। দুই বালতি পরস্পর হতে হাত দশেক দূরে স্থাপিত হল। দুই জুড়ি স্ত্রীপুরুষ বিরোধী পক্ষ অবলম্বন করে পালাক্রমে স্ব স্ব স্থান থেকে কলসীর বিড়ের মতো কতকগুলো রজজুচক্র বিপরীত বালতির মধ্যে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগল। যে পক্ষ সর্বাগ্রে একুশ করতে পারবে তারই জিত। মেয়ে-খেলোয়াড়েরা কখনো জয়োচ্ছাসে কখনো নৈরাশ্যে উর্ধর্বকণ্ঠে চীৎকার করে উঠছে। কেউ বা দাড়িয়ে দেখছে, কেউ বা গণনা করছে, কেউ বা খেলায় যোগ দিচ্ছে, কেউ বা আপন আপনি পড়ায় কিংবা গল্পে নিবিষ্ট । একটার সময় আবার ঘণ্টা । আবার আহার । আহারান্তে উপরে ফিরে এসে দুই স্তর খাদ্যের ভরে এবং মধ্যাহ্নের উত্তাপে আলস্য অত্যন্ত ঘনীভূত হয়ে আসে । সমুদ্র প্রশান্ত, আকাশ সুনীল মেঘমুক্ত, অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে। কেদারায় হেলান দিয়ে নীরবে নভেল পড়তে পড়তে অধিকাংশ আনীল নয়ন নিদ্রাবিষ্ট । কেবল দুই-একজন দাবা, ব্যাকগ্যামন কিংবা ড্রাফট খেলছে এবং দুই-একজন অশ্রান্ত অধ্যবসায়ী যুবক সমস্ত দিনই কয়েটস খেলায় নিযুক্ত। কোনো রমণী কোলের উপর কাগজ কলম নিয়ে একাগ্রমনে চিঠি লিখছে এবং কোনো শিল্পকুশলা কৌতুকপ্ৰিয়া যুবতী নিদ্রিত সহযাত্রীর ছবি ক্ৰমে রৌদ্রের প্রখরতা হ্রাস হয়ে এল । তাপক্লিষ্ট ক্লান্তকায়গণ নীচে নেমে গিয়ে রুটি মাখন মিষ্টান্ন -সহযোগে চা-রস পানে শরীরের জড়তা পরিহার করে পুনর্বার ডেকে উপস্থিত । পুনর্বার যুগলমূর্তির সোৎসাহ পদচারণা এবং মৃদুমন্দ হাস্যালাপ আরম্ভ হল। কেবল দু-চারজন পাঠিকা উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদ থেকে কিছুতেই আপনাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না, দিব্যাবসানের স্নান ক্ষীণালোকে একাগ্রনিবিষ্ট দৃষ্টিতে নায়ক-নায়িকার পরিণাম অনুসরণ করছে। দক্ষিণ আকাশে তপ্ত স্বর্ণবর্ণের প্রলেপ, তরল অগ্নির মতো জলরাশির মধ্যে সূর্য অস্তমিত, এবং বামে সূর্যাস্তের কিছু পূর্ব হতেই চন্দ্ৰোদায়ের সূচনা। জাহাজ থেকে পূর্বদিগন্ত পর্যন্ত জ্যোৎস্নারেখা ঝিকঝিক করছে। জাহাজের ডেকের উপরে এবং কক্ষে কক্ষে বিদ্যুদীপ জ্বলে উঠল। ছটার সময় বাজল ডিনারের প্ৰথম ঘণ্টা । বেশপরিবর্তন উপলক্ষে সকলে স্ব স্ব কক্ষে প্ৰবেশ করলে । আধা ঘণ্টা পরে দ্বিতীয় ঘণ্টা । ভোজনগৃহে প্ৰবেশ করা গেল। সারি সারি নরনারী বসে গেছে। কারো বা কালো কাপড়, কারো রঙিন কাপড়, কারো বা শুভ্র বক্ষ অর্ধ-অনাবৃত । মাথার উপরে শ্রেণীবদ্ধ বিদ্যুৎ-আলোক । গুনগুন আলাপের সঙ্গে কীটাচামচের, টুংটাং ঠুং ঠাং শব্দ মুখরিত, এবং বিচিত্র খাদ্যের পর্যায় পরিচারকদের হাতে হাতে নিঃশব্দ স্রোতের মতো যাতায়াত করছে । আহারের পর ডেকে গিয়ে শীতল বায়ু সেবন । কোথাও বা যুবকযুবতী অন্ধকার কোণের মধ্যে চৌকি টেনে নিয়ে গিয়ে গুনগুন করছে, কোথাও বা দুজনে জাহাজের বারান্দা ধরে ঝুকে পড়ে রহস্যালাপে নিমগ্ন, কোনো কোনো জুড়ি গল্প করতে করতে ডেকের আলোক ও অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দ্রুতপদে একবার দেখা দিচ্ছে একবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, কোথাও বা পাচ-সাতজন স্ত্রীপুরুষ এবং জাহাজের কর্মচারী জটলা করে উচ্চহাস্যে প্রমোদকল্লোল উচ্ছসিত করে তুলছে। অলস পুরুষেরা কেউ বা বসে কেউ বা দাড়িয়ে কেউ বা অর্ধশয়ান অবস্থায় চুরট টানছে, কেউ বা স্মেকিং সেলুনে কেউ বা নীচে খাবার ঘরে হুইস্কি সোডা পাশে রেখে চারজনে দল বেঁধে বাজি রেখে তাস খেলছে । ও দিকে সংগীতশালায় সংগীতপ্রিয় দু-চারজনের সমাবেশে গানবাজনা এবং মাঝে মাঝে করতালি শোনা যাচ্ছে । ক্ৰমে সাড়ে-দশটা বাজে, মেয়েরা নেবে যায়, ডেকের উপরে আলো হঠাৎ যায় নিবে, ডেক নিঃশব্দ নির্জন অন্ধকার হয়ে আসে । চারি দিকে নিশীথের নিস্তব্ধতা, চন্দ্রালোক, এবং অনন্ত সমুদ্রের অশ্রান্ত কলধবনি । ২৭ অক্টোবর । লোহিত সমুদ্রের গরম ক্রমেই বেড়ে উঠছে। ডেকের উপর মেয়েরা সমস্ত দিন তৃষাতুরা হরিণীর মতো ক্লিষ্ট কাতর। তারা কেবল অতি ক্লান্তভাবে পাখা নাড়ছে, স্মেলিং সল্ট শুকছে,