পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি bró ዒ এবং সকরুণ যুবকেরা যখন পাশে এসে কুশল জিজ্ঞাসা করছে তখন নিমীলিতপ্ৰায় নেত্রপল্লব ঈষৎ উন্মীলন করে স্নানহাস্যে কেবল গ্ৰীবাভঙ্গি দ্বারা আপন সুকুমার দেহলতার একান্ত অবসন্নতা ইঙ্গিতে জানাচ্ছে। যতই পরিপূর্ণ করে টিফিন এবং লেবুর শরবৎ খাচ্ছে, ততই জড়ত্ব এবং ক্লান্তি বাড়ছে, নেত্ৰ । নিদ্রানিত ও সর্বশরীর শিথিল হয়ে আসছে। ২৮ অক্টোবর । আজ এডেনে পৌঁছনো গেল । ২৯ অক্টোবর । আমাদের জাহাজে একটি পার্সি সহযাত্রী আছে। তার ছুচােলো ছাটা দাড়ি এবং বড়ো বড়ো চোখ সর্বপ্রথমেই চােখে পড়ে । অল্প বয়স। নয় মাস যুরোপে বেড়িয়ে বিলিতি পোশাক এবং চালচলন ধরেছে। বলে, ইন্ডিয়া লাইক করে না । বলে, তার যুরোপীয় বন্ধুদের (অধিকাংশই স্ত্রীবন্ধু) কাছ থেকে তিনশো চিঠি এসে তার কাছে জমেছে, তাই নিয়ে বেচারা মহা মুশকিলে পড়েছে, কখনই বা পড়বে কখনই বা জবাব দেবে। লোকটা আবার নিজে বন্ধুত্ব করতে বড়োই নারাজ, কিন্তু বিধাতার বিড়ম্বনায় বন্ধুত্ব তার মাথার উপরে অনাহুত অযাচিত বৰ্ষিত হতে থাকে । সে বলে, বন্ধুত্ব করে কোনো ‘ফান নেই। উপরন্তু কেবল ল্যাঠা । এমন-কি, শত শত জর্মন ফরাসি ইটালিয়ান এবং ইংরেজ মেয়ের সঙ্গে সে ‘ফ্লাট’ করে এসেছে, কিন্তু তাতে কোনো মজা পায় নি । ২ নবেম্বর । ভারতবর্ষের কাছাকাছি আসা গেছে। কাল বোম্বাই পৌছবার কথা । আজ সুন্দর সকালবেলা । ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, সমুদ্র সফেন তরঙ্গে নৃত্য করছে, উজ্জ্বল রৌদ্র উঠেছে ; কেউ কয়েটস খেলছে, কেউ নভেল পড়ছে, কেউ গল্প করছে। মুজিক সেলুনে গান, স্মোকিং সেলুনে তাস, ডাইনিং সেলুনে খানার আয়োজন হচ্ছে এবং একটি সংকীর্ণ ক্যাবিনের মধ্যে আমাদের একটি বৃদ্ধ সহযাত্রী মরছে । সন্ধ্যা আটটার সময় ডিলন সাহেবের মৃত্যু হল । আজ সন্ধ্যার সময় একটি নাটক অভিনয় হবার কথা ছিল । ৩ নবেম্বর । সকালে অন্ত্যেষ্টি-অনুষ্ঠানের পর ডিলনের মৃতদেহ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হল । আজ আমাদের সমুদ্রযাত্রার শেষ দিন । অনেক রাত্রে জাহাজ বোম্বাই বন্দরে পীেছল । ৪ নবেম্বর । জাহাজ ত্যাগ করে ভারতবর্ষে নেমে এখন আমার অদৃষ্টের সঙ্গে আর কোনো মনান্তর নেই | সংসারটা মোটের উপরে বেশ আনন্দের স্থান বোধ হচ্ছে । কেবল একটা গোল বেধেছিলটাকাকড়ি-সমেত আমার ব্যাগটি জাহাজের ক্যাবিনে ফেলে এসেছিলুম, তাতে করে সংসারের আবহাওয়ার হঠাৎ অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু হােটেল থেকে অবিলম্বে জাহাজে ফিরে গিয়ে সেটি সংগ্রহ করে এনেছি। এই ব্যাগ ভুলে যাবার সম্ভাবনা কাল চকিতের মতো একবার মনে উদয় হয়েছিল। মনকে তখনই সাবধান করে দিলুম, ব্যাগটি যেন না ভোলা হয় । মন বললে, ক্ষেপেছ! আজি সকালে তাকে বৃথা ভৎসনা করেছি। নষ্টোদ্ধার করে হােটেলে ফিরে এসে স্নানের পর আরাম বোধ হচ্ছে। এই ঘটনা নিয়ে আমার বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি কটাক্ষপাত করবেন সৌভাগ্যক্রমে এমন প্ৰিয়বন্ধু কেউ উপস্থিত নেই। সুতরাং রাত্রে যখন কলিকাতামুখী গাড়িতে চড়ে বসা গেল, তখন যদিও আমার বালিশটা ভ্ৰমক্ৰমে হােটেলে ফেলে এসেছিলুম। তবু সুখনিদ্রার বিশেষ ব্যাঘাত হয় নি ।