পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চিঠিপত্র brとか○ ছোটো ভাইরাও আমার কথা মানিবে না, দাদামহাশয়ের কাজ আমার দ্বারা একেবারেই সম্পন্ন হইতে পরিবে না । এই কর্তব্যপাশে বাধিয়া রাখিবার জন্য, পরস্পরের প্রতি পরস্পরের কর্তব্য অবিশ্রাম স্মরণ করাইয়া দিবার জন্য সমাজে অনেকগুলি দস্তুর প্রচলিত আছে । সৈন্যদের যেমন অসংখ্য নিয়মে বদ্ধ দস্তুরে বদ্ধ থাকিতে হয়, নতুবা তাহারা সমাজের কার্য পালনের জন্য প্রস্তুত হইতে পারে না । যে গুরুজনকে তুমি প্ৰণাম করিয়া থাক, র্যাহাকে প্রত্যেক চিঠিপত্ৰে তুমি ভক্তির সম্ভাষণ করা, যাহাকে দেখিলে তুমি উঠিয়া দাড়াও, ইচ্ছা করিলেও সহসা তাহাকে তুমি অমান্য করিতে পারো না, সহস্র দস্তুর পালন করিয়া এমনি তোমার মনের শিক্ষা হইয়া যায় যে, গুরুজনকে মান্য করা তোমার পক্ষে অত্যন্ত সহজ হইয়া উঠে, না করা তোমার পক্ষে সাধ্যাতীত হইয়া উঠে । আমাদের প্রাচীন দস্তুর সমস্ত ভাঙিয়া ফেলিয়া আমরা এই-সকল শিক্ষা হইতে বঞ্চিত হইতেছি । ভক্তি-স্নেহের বন্ধন ছিড়িয়া যাইতেছে। পারিবারিক সম্বন্ধ উলটা-পালটা হইয়া যাইতেছে । সমাজে বিশৃঙ্খলা জন্মিতেছে। তুমি যে দাদামহাশয়কে প্ৰণাম করিয়া চিঠি আরম্ভ কর না সেটা শুনিতে অত্যন্ত সামান্য বােধ হইতে পারে, কিন্তু নিতান্ত সামান্য নহে। অনেকগুলি দস্তুর আমাদের হৃদয়ের সহিত জড়িত, তাহা কতটুকু দস্তুর কতটুকু হৃদয়ের কার্য বলা যায় না । অকৃত্ৰিম ভক্তির উচ্ছাসে আমরা প্ৰণাম করি কেন ? প্ৰণাম করাও তো একটা দস্তুর । এমন দেশ আছে যেখানে ভক্তিভাবে প্ৰণাম না করিয়া আর-কিছু করে । আমরা প্ৰণাম না করিয়া হা করি না কেন ? প্ৰণামের প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, ভক্তির বাহালক্ষণস্বরূপ একপ্রকার অঙ্গভঙ্গি আমাদের দেশে চলিয়া আসিতেছে । যাহাকে আমরা ভক্তি করি তাহাকে স্বভাবতই আমাদের হৃদয়ের ভক্তি দেখাইতে ইচ্ছা হয়, প্ৰণাম করা সেই ভক্তি দেখাইবার উপায় মাত্র । আমি যদি প্ৰণাম না। পরিবেন না, এমন-কি, তাহা অপমান জ্ঞান করিতে পারেন । ভক্তি দেখাইবার সময়ে হাততালি দেওয়াই যদি দস্তুর থাকিত, তাহা হইলে প্ৰণাম করা অত্যন্ত দোষের হইত সন্দেহ নাই । অতএব দস্তুরকে পরিত্যাগ করিয়া আমরা হািদয়ের ভাব প্ৰকাশ করিতে পারি না, হৃদয়ের অভাব প্ৰকাশ করি বটে । অতএব আমাকে প্ৰণামপুরঃসর চিঠি লিখিবে, ভক্তি থােক। আর নাই থাক— সে দেখিতে বড়ো ভালো হয় । তোমার দেখাদেখি আর পাচজনে দাদামহাশয়কে ভদ্র রকমে চিঠি লিখিতে শিখিবে এবং ক্ৰমে ভক্তি করিতেও শিখিবে । আশীর্বাদক শ্ৰীষষ্ঠীচরণ দেবশমণঃ শ্ৰীচরণকমলযুগলেষু আরো ভক্তি চাই ! যুগলের উপর আরো এক-জোড়া বাড়াইয়া দিব । দাদামহাশয়, তোমার অন্ত পাওয়া ভার, চিরকাল তুমি আমাদের সঙ্গে ঠাট্টােতামাশা করিয়া আসিয়াছ, আর আজ হঠাৎ ভক্তি আদায় করিবার জন্য আমাদের উপর এক পরোয়ানাপত্ৰ বাহির করিয়াছ, ইহার অর্থ কী ? আমি । দেখিয়াছি, যে অবধি তোমার সুমুখের এক-জোড়া দাঁত পড়িয়া গিয়াছে সেই অবধি তোমার মুখে কিছুই বাধে না । তোমার দাঁত গিয়াছে বটে, কিন্তু তীব্র ধারটুকু তোমার জিভের আগায় রহিয়া গিয়াছে। আর আগেকার মতো পরমানন্দে রুইমাছের মুড়ো চিবাইতে পারো না, সুতরাং দংশন করিবার সুখ তোমার নিরীহ নাতিদের কােছ হইতে আদায় কর । তোমার দন্তহীন হাসিটুকু আমার বড়ো মিষ্ট লাগে । কিন্তু তোমার দন্তহীন দংশন আমার তেমন উপাদেয় বলিয়া বোধ হয় না ।