পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brWobr রবীন্দ্র-রচনাবলী 8 শ্ৰীচরণেষু দাদামশায়, তোমার চিঠি ক্ৰমেই হেঁয়ালি হইয়া উঠিতেছে । আমাদের চোখে এ চিঠি অত্যন্ত ঝাপসা ঠেকে। কোথায় রামচন্দ্ৰ হরিশ্চন্দ্ৰ দধীচি, অতি দূরে আমাদের দৃষ্টি চলে না । তোমরাই তো বল আমাদের দূরদর্শিতা নাই, অতএব দূরের কথা দূর করিয়া নিকটের কথা তুলিলেই ভালো হয়। আমরা যে মস্ত জাতি, আমাদের মতো এতবড়ো জাতি যে পৃথিবীর আর কোথাও মেলে না, তাহাতে আমাদের মনে আর কিছুমাত্ৰ সংশয় নাই। বেদ বেদান্ত আগম নিগম পুরাণ হইতে ইহা অকাট্যরূপে প্রমাণ করিয়া দেওয়া যায়। আমাদের বেলুন ছিল, রেলগাড়ি ছিল, আমাদের স্টাইলোগ্রাফ পেন ছিল, গণপতি তাহাতে মহাভারত লিখিয়াছিলেন, ডারুইনের বহুপূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষেরা তঁহাদের পূর্বতর পুরুষদিগকে বানর বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন, আধুনিক বিজ্ঞানের সমুদয় সিদ্ধান্তই শাণ্ডিল্য-ভৃগু-গৌতমের সম্পূৰ্ণ জানা ছিল, ইহা সমস্তই মানিলাম।— কিন্তু তাই বলিয়াই যে আমরা আমাদের কৌলীন্য লইয়া স্ফীত হইতে থাকিব, সেই সুদূর কুটুম্বিতার মধ্যেই গুটি মারিয়া বসিয়া থাকিব, কাছাকাছির সহিত কোনো সম্পর্ক রাখিব না, এমন হইতে পারে না । বাল্যকালে একদিন উত্তমরূপে পোলাও খাওয়া হইয়াছিল বলিয়া যে অবশিষ্ট জীবন ভাতের প্রতি অবজ্ঞা প্ৰদৰ্শন করিতে হইবে, এমন কোনো কথা নাই। আমাদের বৈদিক পৌরাণিক যুগ যে চলিয়া গেছে। এ বড়ো দুঃখের বিষয়, এখন সকাল-সকাল এই দুঃখ সারিয়া লইয়া বর্তমান যুগের কাজ করিবার জন্য একটু সময় করিয়া লওয়া আবশ্যক । আমি যখন বলিয়াছিলাম ভাবের প্রতি আমাদের দেশের লোকের নিষ্ঠা নাই, ব্যক্তির প্রতিই আসক্তি, তখন আমি রামচন্দ্র-হরিশ্চন্দ্র-দধীচির কথা মনেও করি নাই- কীটের মতো যেখানকার যত পুরাতত্ত্বানুসন্ধানে আমার উৎসাহ নাই। আমি অপেক্ষাকৃত আধুনিকের কথাই বলিতেছি। তর্কবিতর্কের প্রবৃত্তি দূর করিয়া একবার ভাবিয়া দেখো দেখি, মহৎ ভাবকে উপন্যাসগত কুহেলিকা জ্ঞান না করিয়া মহৎ ভাবকে সত্য মনে করিয়া, তাহাকে বিশ্বাস করিয়া, তাহার জন্য আমাদের দেশে কয়জন লোক আত্মসমৰ্পণ করে । কেবল দলাদলি, কেবল “আমি আমি আমি এবং “অমুক অমুক অমুক' করিয়াই মরিতেছি । আমাকে এবং অমুককে অতিক্রম করিয়াও যে দেশের কোনো কাজ, কোনো মহৎ অনুষ্ঠান বিরাজ করিতে পারে, ইহা আমরা মনে করিতে পারি না । এইজন্য আপন আপন অভিমান লইয়াই আমরা থাকি । আমাকে বড়ো চৌকি দেয় নাই, অতএব এ সভায় আমি থাকিব নাআমার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করে নাই, অতএব ও কাজে আমি হাত দিতে পারি না- সে সমাজের সেক্রেটারি অমুক, অতএব সে সমাজে আমার থাকা শোভা পায় না— আমরা কেবল এই ভাবিয়াই মারি । সুপারিশের খাতির এড়াইতে পারি না, চক্ষুলজ্জা অতিক্রম করিতে পারি না, আমার একটা কথা অগ্রাহ্য হইলে সে অপমান সহ্য করিতে পারি না। দুর্ভিক্ষনিবারণের উদ্দেশে কেহ যদি আমার সাহায্য লাইতে আসে, আমি পাচ টাকা দিয়া মনে করি তাহাকেই ভিক্ষা দিলাম, তাহাকেই সবিশেষ বাধিত করিলাম- সে এবং তাহার উর্ধর্বতন চতুর্দশ-সংখ্যক পূর্বপুরুষের নিকট হইতে মনে মনে কৃতজ্ঞতা দাবি করিয়া থাকি । নহিলে মনের তৃপ্তি হয় না। কোনো ব্যক্তিবিশেষকে বাধিত করিলাম না— আমি রহিলাম কলিকাতার এক কোণে, বীরভূমের এক কোণে এক ব্যক্তি আমার টাকায় মাসখানেক ধরিয়া দুই মুঠ ভাত খাইয়া লইল- ভারি তো আমার গরজ ! পরোপকারী বলিয়া নাম বাহির হয়। কার ? যে ব্যক্তি আশ্রিতদের উপকার করে। অর্থাৎ, একজন আসিয়া কহিল, “মহাশয়, আপনার হাত ঝাড়িলে পর্বত, আপনি ইচ্ছা করিলে অনায়াসে আমার একটা গতি করিতে পারেন- আমি আপনাদেরই আশ্রিত।” মহামহিম মহিমাৰ্ণব। আমনি অবহেলে গুড়গুড়ি হইতে ধূমাকৰ্ষণপূর্বক অকাতরে বলিলেন, “আচ্ছা !’ বলিয়া পত্ৰযোগে একজন বিশ্বাসপরায়ণ বান্ধবের ঘাড়ে সেই অকৰ্মণ্য অপদার্থকে নিক্ষেপ করিলেন । আর-এক জন হতভাগ্য অগ্ৰে তাহার কাছে না গিয়া পাচুবাবুর কাছে গিয়াছিল, এই