পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চিঠিপত্ৰ ԵrԳ Տ কঁচা চুল আগাগোড়া উৎপাটন করিয়া তাহার পরিবর্তে তাহারা পাকা চুল বুনানি করিতে চায় ; তাহারা যে এক কালে যুবা ছিল তাহা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া যায়, এইজন্য যৌবন তাঁহাদের নিকটে একেবারে দুর্বোিধ হইয়া পড়ে । যৌবনের গান শুনিয়া তাহারা কানে আঙুল দেয়, যৌবনের কাজ দেখিয়া তাহারা মনে করে পৃথিবীতে কলিযুগের প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। শ্যামল কিশলয়ের অসম্পূর্ণতা দেখিয়া ধূলিশায়ী জীৰ্ণ পত্র যেমন অত্যন্ত শুষ্ক পীত হাস্য হাসিতে থাকে, অপরিণত যৌবনের সরস শ্যামলতা দেখিয়া অনেক বৃদ্ধ তেমনি করিয়া হাসিয়া থাকে । এইজন্যই ছেলে-বুড়োর মাঝখানে এত দৃঢ় ব্যবধান পড়িয়া গিয়াছে। আমার কি ভাই, সাধ যে কেবল কতকগুলো উপদেশের ধোওয়া দিয়া তোমাদের কাচা মাথা একদিনে পাকাইয়া তুলি ! কাজ করিতে যদি পরিতাম তা হইলে কি আর সমালোচনা করিতে বসিতাম ! তোমরা যুবা, তোমাদের কত সুখ আছে বলো দেখি । আমাদের উদ্যমের সুখ নাই, কর্মানুষ্ঠানের সুখ নাই, একমাত্ৰ বকুনির সুখ আছে— তাহাও সম্মুখের দস্তাভাবে ভালোরূপে সমাধা হয় না । ইহাতেও তোমরা চটিলে চলিবে কেন ! কাজ নাই ভাই— আমার সংশয়, আমার বিজ্ঞতা, আমার কাছেই থােক ; তোমরা নিঃসংশয়ে কাজ করো, নিৰ্ভয়ে অগ্রসর হও । নূতন নূতন জ্ঞানের অনুসন্ধান করো, সত্যের জন্য সংগ্রাম করো, জগতের কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করিয়া দীর্ঘজীবন লাভ করে । যে স্রোতে পড়িয়াছ, এই স্রোতাকেই অবলম্বন করিয়া উন্নতি-তীর্থের দিকে ধাবমান হও ; নিমগ্ন হইলো লজার কারণ নাই ; উত্তীর্ণ হইতে পারিলে তোমাদের জন্মলাভ সার্থক হইবে, তোমাদের দুঃখিনী জন্মভূমি ধন্য হইবে । আমি যে চিরজীবন কাটাইয়া অবশেষে যাবার মুখে তোমাদের দুটাে-একটা কথা বলিয়া যাইতেছি, তাহা শুনিলে যে তোমাদের উপকার হইবে না, এ কথা আমার বিশ্বাস হয় না । তাহার সকল কথাই যে বেদবাক্য তাহা নহে, কিম্বা তাহার সকল কথাই যে এখনকার দিনে খাটিবে তাহাও নহে, কিন্তু ইহা নিঃসংশয় যে তাহাতে কিছু-না-কিছু সত্য আছেই— আমার এই সুদীর্ঘ জীবন কিছু সমস্ত ব্যর্থ, সমস্ত মিথ্যা নহে। এই সংশয়াচ্ছন্ন সংসারে আমার দীর্ঘ জীবন যে সত্যপথনির্দেশের কিছুমাত্ৰ সহায়তা করিবে না। তাহা আমার মন বলিতে চায় না । এইজন্য, আমি কোনো দৃঢ় অনুশাসন প্রচার করিতে চাই না, আমি বলিতে চাই না। আমার সমস্ত কথা আগাগোড়া পালন না করিলে তোমরা উৎসন্ন যাইবে, আমি কেবল এই বলিতে চাই— আমার কথা মনোযোগ দিয়া শুন, একেবারে কানে আঙুল দিয়ে না, তার পরে বিচার করো, বিবেচনা করো, যাহা ভালো বোধ হয় তাহা গ্ৰহণ করে । সম্মুখের দিকে অগ্রসর হও, কিন্তু পশ্চাতের সহিত বিবাদ করিয়ো না । এক প্রেমের সূত্রে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎকে বাধিয়া রাখে | আমার তো, ভাই, যাবার সময় হইয়াছে। যাত্যেকতোহস্তশিখরং পতিরোষধীনা মাবিষ্কৃতারুণপুরঃসর একতোহার্ক: । আমরা সেই অস্তগামী চন্দ্ৰ, আমরা রজনীতে বঙ্গভূমির নিদ্রিতাবস্থায় বিরাজ করিতেছিলাম। তখন যে একটি সুগভীর শান্তি ও সুস্নিগ্ধ মাধুর্য ছিল তাহা অস্বীকার করিবার কথা নহে, কিন্তু তাই বলিয়া আজ এই—যে কর্মকোলাহল জগাইয়া অরুণোদয় হইতেছে, ইহাকে সাদর সম্ভাষণ না করিব কেন ? কেন বলিব তীক্ষাপ্রভ দিবসের প্রয়োজন নাই, রজনীর পরে রজনী ফিরিয়া আসুক ? এসো অরুণ, এসো, তুমি আকাশ অধিকার করো— আমি নীরবে তোমাকে পথ ছাড়িয়া দিই। আমি তোমার দিকে চাহিয়া ক্ষীণহাস্যে তোমাকে আশীর্বাদ করিয়া বিদায় গ্ৰহণ করি । আমার নিদ্রা, আমার শান্ত নীরবতা, আমার স্নিগ্ধ হিমসিক্ত রজনী আমার সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হইয়া যাকতোমারই সমুজ্জ্বল মহিমা জীবন বিতরণ করিয়া জলে স্থলে চরাচরে ব্যাপ্ত হইতে থাকুক । আশীৰ্বাদক শ্ৰীষষ্ঠীচরণ দেবশর্মণঃ