পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত brbrዒ ক্ষিতি যেমন র্তার বিরোধী পক্ষের কোনো যুক্তি খণ্ডন করিতে বসা নিতান্ত বাহুল্য জ্ঞান করেন, আমাদের ব্যোমও তেমনি একটা কথা বলিয়া চুপ মারিয়া থাকেন, তাহার পর যে যাহা বলে তাহার গাভীর্য নষ্ট করিতে পারে না । আমার কথাও তাহাকে স্পর্শ করিতে পারিল না । ক্ষিতি যেখানে ছিল সেইখানেই অটল হইয়া রহিল এবং ব্যোমও আপনার প্রচুর গোফ দাড়ি ও গভীর্যের মধ্যে সমাহিত হইয়া রহিলেন । এই তো আমি এবং আমার পঞ্চভূত সম্প্রদায় । ইহার মধ্যে শ্ৰীমতী দীপ্তি একদিন প্ৰাতঃকালে আমাকে কহিলেন- তুমি তোমার ডায়ারি রাখ-না কেন ? মেয়েদের মাথায় অনেকগুলি অন্ধ সংস্কার থাকে, শ্ৰীমতী দীপ্তির মাথায় তন্মধ্যে এই একটি সংস্কার ছিল যে, আমি নিতান্ত যে-সে লোক নহি । বলা বাহুল্য, এই সংস্কার দূর করিবার জন্য আমি অত্যধিক প্ৰয়াস পাই নাই । সমীর উদার চঞ্চল ভাবে আমার পৃষ্ঠে চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন— লেখো-না হে। ক্ষিতি এবং ব্যোম চুপ করিয়া রহিলেন । আমি বলিলাম- ডায়ারি লিখিবার একটি মহদোষ আছে । দীপ্তি অধীর হইয়া বলিয়া উঠিলেন— তা থাক, তুমি লেখো । স্রোতস্বিনী মৃদুস্বরে কহিলেন— কী দোষ, শুনি । আমি কহিলাম— ডায়ারি একটা কৃত্রিম জীবন । কিন্তু যখনই উহাকে রচিত করিয়া তোলা যায়, তখনই ও আমাদের প্রকৃত জীবনের উপর কিয়ৎপরিমাণে আধিপত্য না করিয়া ছাড়ে না। একটা মানুষের মধ্যেই সহস্ৰ ভাগ আছে, সব কটাকে সামলাইয়া সংসার চালানো এক বিষম আপদ, আবার বাহির হইতে স্বহস্তে তাহার একটি কৃত্রিম জুড়ি বানাইয়া দেওয়া আপদ বৃদ্ধি করা মাত্র । কোথাও কিছুই নাই, ব্যোম বলিয়া উঠিলেন— সেইজন্যই তো তত্ত্বজ্ঞানীরা সকল কর্মই নিষেধ করেন । কারণ কর্মমাত্রই এক-একটি সৃষ্টি । যখনই তুমি একটা কর্ম সৃজন করিলে তখনই সে অমরত্ব লাভ করিয়া তোমার সহিত লাগিয়া রহিল । আমরা যতই ভাবিতেছি, ভোগ করিতেছি, ততই আপনাকে নানা-খানা করিয়া তুলিতেছি । অতএব বিশুদ্ধ আত্মটিকে যদি চাও, তবে সমস্ত ভাবনা, সমস্ত সংস্কার, সমস্ত কাজ ছাড়িয়া দাও । আমি ব্যোমের কথার উত্তর না দিয়া কহিলাম— আমি নিজেকে টুকরা টুকরা করিয়া ভাঙিতে চাহি না । ভিতরে একটা লোক প্রতিদিন সংসারের উপর নানা চিন্তা, নানা কাজ গাথিয়া গাথিয়া এক অনাবিষ্কৃত নিয়মে একটি জীবন গড়িয়া চলিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে ডায়ারি লিখিয়া গেলে তাহাকে ভাঙিয়া আর-একটি লোক গড়িয়া আর-একটি দ্বিতীয় জীবন খাড়া করা হয় । কিন্তু খুলিয়া কহিল—ডায়ারিকে কেন যে দ্বিতীয় জীবন বলতেই আমি তাে এপর্যন্ত বুঝতে রলাম না । আমি কহিলাম— আমার কথা এই, জীবন এক দিকে একটা পথ আঁকিয়া চলিতেছে, তুমি যদি ঠিক তার পাশে কলম হস্তে তাহার অনুরূপ আর-একটা রেখা কাটিয়া যাও, তবে ক্রমে এমন অবস্থা আসিবার সম্ভাবনা, যখন বোঝা শক্ত হইয়া দাড়ায়- তোমার কলম তোমার জীবনের সমপাতে লাইন কাটিয়া যায়, না, তোমার জীবন তোমার কলমের লাইন ধরিয়া চলে। দুটি রেখার মধ্যে কে আসল কে নকল ক্ৰমে স্থির করা কঠিন হয় । জীবনের গতি স্বভাবতই রহস্যময়, তাহার মধ্যে অনেক আত্মখণ্ডন, অনেক স্বতোবিরোধ, অনেক পূর্বাপরের অসামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু লেখনী স্বভাবতই একটা সুনির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করিতে চাহে । সে সমস্ত বিরোধের মীমাংসা করিয়া সমস্ত অসামঞ্জস্য সমান করিয়া, । কেবল একটা মোটামুটি রেখা টানিতে পারে। সে একটা ঘটনা দেখিলে তাহার যুক্তিসংগত সিদ্ধান্তে উপস্থিত না হইয়া থাকিতে পারে না । কাজেই তাহার রেখাটা সহজেই তাহার নিজের গড়া সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে, এবং জীবনকেও তাহার সহিত মিলাইয়া আপনার অনুবতী করিতে চাহে। কথাটা ভালো করিয়া বুঝাইবার জন্য আমার ব্যাকুলতা দেখিয়া স্রোতস্বিনী দয়াৰ্দচিত্তে কহিল—