পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bra)○ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী স্রোতস্বিনী কিঞ্চিৎ ভীত হইয়া উঠিল । সমীর করজোড়ে কহিল- দোহাই তোমার, সব কথা যদি লেখায় ওঠে, তবে বাড়ি হইতে কথা মুখস্থ করিয়া আসিয়া বলিব এবং বলিতে বলিতে যদি হঠাৎ মাঝখানে ভুলিয়া যাই, তবে আবার বাড়ি গিয়া দেখিয়া আসিতে হইবে । তাহাতে ফল হইবে এই যে, কথা বিস্তর কমিবে এবং পরিশ্রম বিস্তর বাড়িবে। যদি খুব-ঠিক সত্য কথা লেখ, তবে তোমার সঙ্গ হইতে নাম কাটাইয়া আমি চলিলাম । আমি কহিলাম— আরে না, সত্যের অনুরোধ পালন করিব না, বন্ধুর অনুরোধই রাখিব । তোমরা কিছু ভাবিয়ে না, আমি তােমাদের মুখে কথা বানাইয়া দিব । ক্ষিতি বিশাল চক্ষু প্রসারিত করিয়া কহিল— সে যে আরো ভয়ানক । আমি বেশ দেখিতেছি। তোমার হাতে লেখনী পড়িলে যত-সব কুযুক্তি আমার মুখে দিবে, আর তাহার অকাট্য উত্তর নিজের মুখ দিয়া বাহির করিবে । আমি কহিলাম— মুখে যাহার কাছে তর্কে হারি, লিখিয়া তাহার প্রতিশোধ না নিলে চলে না। আমি আগে থাকিতেই বলিয়া রাখিতেছি, তোমার কাছে যত উপদ্রব এবং পরাভব সহ্য করিয়াছি। এবারে তাহার প্রতিফল দিব । সর্বসহিষ্ণু ক্ষিতি সন্তুষ্টচিত্তে কহিল— তথাস্তু । W ব্যোম কোনো কথা না বলিয়া ক্ষণকালের জন্য ঈষৎ হাসিল, তাহার সুগভীর অর্থ আমি এ পর্যন্ত বুঝিতে পারি নাই । 瓦问 > 、浏 সৌন্দর্যের সম্বন্ধ বর্ষায় নদী ছাপিয়া খেতের মধ্যে জল প্ৰবেশ করিয়াছে। আমাদের বোট অর্ধমগ্ন ধানের উপর দিয়া সর অদূরে উচ্চভূমিতে একটা প্রাচীরবেষ্টিত একতালা কোঠাবাড়ি এবং দুই-চারিটি টিনের-ছাদ-বিশিষ্ট কুটির, কলা কঁঠাল আমি বঁাশঝাড় এবং বৃহৎ বাধানো অশথ গাছের মধ্য দিয়া দেখা যাইতেছে। সেখান হইতে একটা সরু সুরের সানাই এবং গোটাকতক ঢাক-ঢোলের শব্দ শোনা গেল । সানাই অত্যন্ত বেসুরে একটা মেঠো রাগিণীর আরম্ভ-অংশ বারংবার ফিরিয়া ফিরিয়া নিষ্ঠুরভাবে বাজাইতেছে এবং ঢাক-ঢোলগুলা যেন অকস্মাৎ বিনা কারণে খেপিয়া উঠিয়া বায়ুরাজ্য লণ্ডভণ্ড করিতে উদ্যত হইয়াছে । স্রোতস্বিনী মনে করিল, নিকটে কোথাও বুঝি একটা বিবাহ আছে। একান্ত কৌতুহলভারে বাতায়ন হইতে মুখ বাহির করিয়া তরুসমাচ্ছন্ন তীরের দিকে উৎসুক দৃষ্টি চালনা করিল। আমি ঘাটে বাধা নীেকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলাম— কী রে, বাজনা কিসের ? সে কহিল— আজ জমিদারের পুণ্যাহ। পুণ্যাহ বলিতে বিবাহ বুঝায় না শুনিয়া স্রোতস্বিনী কিছু ক্ষুন্ন হইল। সে ঐ তরুচ্ছায়াঘন গ্ৰাম্য পথটার মধ্যে কোনো এক জায়গায় ময়ুরপংখিতে একটি চন্দনচর্চিত অজাতশ্মশ্র নববর অথবা লজ্জামণ্ডিতা রক্তাম্বারা নববধূকে দেখিবার প্রত্যাশা করিয়াছিল। আমি কহিলাম— পুণ্যাহ অর্থে জমিদারি বৎসরের আরম্ভ-দিন । আজ প্রজারা যাহার যেমন ইচ্ছা! কিছু কিছু খাজনা লইয়া কাছারি-ঘরে টােপরা-পরা বরবেশধারী নায়েবের সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিবে । সে টাকা সেদিন গণনা করিবার নিয়ম নাই । অর্থাৎ খাজনা দেনা-পাওনা যেন কেবলমাত্র স্বেচ্ছাকৃত একটা আনন্দের কাজ । ইহার মধ্যে এক দিকে নীচ লোভ অপর দিকে হীন ভয় নাই । প্রকৃতিতে তরুলতা যেমন আনন্দমহােৎসবে বসন্তকে পুষ্পাঞ্জলি দেয় এবং বসন্ত তাহা সঞ্চয়-ইচ্ছায়