পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত br& > গণনা করিয়া লয় না, সেইরূপ ভাবটা আর-কি । দীপ্তি কহিল- কাজটা তো খাজনা-আদায়, তাহার মধ্যে আবার বাজনা বাদ্য কেন ? ক্ষিতি কহিল- ছাগশিশুকে যখন বলিদান দিতে লইয়া যায় তখন কি তাহাকে মালা পরাইয়া বাজনা বাজায় না ? আজ খাজনা-দেবীর নিকটে বলিদানের বাদ্য বাজিতেছে। আমি কহিলাম— সে হিসাবে দেখিতে পার বটে, কিন্তু বলি যদি দিতেই হয় তবে নিতান্ত পশুর মতো পশুহত্যা না করিয়া উহার মধ্যে যতটা পারা যায় উচ্চভাব রাখাই ভালো । ক্ষিতি কহিল— আমি তো বলি যেটার যাহা সত্য ভাব তাহাঁই রক্ষা করা ভালো ; অনেক সময়ে নীচ কাজের মধ্যে উচ্চ ভাব আরোপ করিয়া উচ্চ ভাবকে নীচ করা হয় । আমি কহিলাম— ভাবের সত্যমিথ্যা অনেকটা ভাবনার উপরে নির্ভর করে । আমি এক ভাবে এই বর্ষার পরিপূর্ণ নদীটিকে দেখিতেছি, আর ঐ জেলে আর-এক ভাবে দেখিতেছে— আমার ভাব যে একচুল মিথ্যা এ কথা আমি স্বীকার করিতে পারি না । সমীর কহিল— অনেকের কাছে ভাবের সত্যমিথ্যা ওজন-দরে পরিমাপ হয় । যেটা যে পরিমাণে মোটা সেটা সেই পরিমাণে সত্য । সৌন্দর্যের অপেক্ষা ধূলি সত্য, স্নেহের অপেক্ষা স্বাৰ্থ সত্য, প্রেমের অপেক্ষা ক্ষুধা সত্য । আমি কহিলাম।— কিন্তু তবু চিরকাল মানুষ এই-সমস্ত ওজনে-ভারী মোটা জিনিসকে একেবারে অস্বীকার করিতে চেষ্টা করিতেছে। ধূলিকে আবৃত করে, স্বার্থকে লজ্জা দেয়, ক্ষুধাকে অন্তরালে নির্বাসিত করিয়া রাখে। মলিনতা পৃথিবীতে বহুকালের আদিম সৃষ্টি ; ধূলিজঞ্জালের অপেক্ষা প্রাচীন পদার্থ মেলাই কঠিন ; তাই বলিয়া সেইটেই সব চেয়ে সত্য হইল, আর অন্তর-অন্তঃপুরের যে লক্ষ্মীরূপিণী গৃহিণী আসিয়া তাহাকে ক্রমাগত ধৌত করিতে চেষ্টা করিতেছে তাহাকেই কি মিথ্যা বলিয়া উড়াইয়া দিতে হইবে ? ক্ষিতি কহিল— তোমরা, ভাই, এত ভয় পাইতেছ। কেন ? আমি তোমাদের সেই অন্তঃপুরের ভিত্তিতলে ডাইনামাইট লাগাইতে আসি নাই। কিন্তু একটু ঠাণ্ডা হইয়া বলে দেখি, পুণ্যাহের দিন ঐ রেসুরো সানাইটা বাজাইয়া পৃথিবীর কী সংশোধন করা হয় ? সংগীতকলা তো নহেই । সমীর কহিল- ও আর কিছুই নহে, একটা সুর ধরাইয়া দেওয়া । সংবৎসরের বিবিধ পদস্থলন এবং ছন্দপতনের পর পুনর্বার সমের কাছে আসিয়া একবার ধুয়ায় আনিয়া ফেলা । সংসারের স্বার্থকোলাহলের মাঝে মাঝে একটা পঞ্চম সুর সংযোগ করিয়া দিলে নিদেন ক্ষণকালের জন্য পৃথিবীর শ্ৰী ফিরিয়া যায়, হঠাৎ হাটের মধ্যে গৃহের শোভা আসিয়া আবির্ভূত হয়, কেনাবেচার উপর ভালোবাসার স্নিগ্ধ দৃষ্টি চন্দ্রালোকের ন্যায় নিপতিত হইয়া তাহার শুষ্ক কঠোরতা দূর করিয়া দেয়। যাহা হইয়া থাকে পৃথিবীতে তাহা চীৎকারস্বরে হইতেছে, আর, যাহা হওয়া উচিত তাহা মাঝে মাঝে এক-একদিন আসিয়া মাঝখানে বসিয়া সুকোমল সুন্দর সুরে সুর দিতেছে, এবং তখনকার মতো সমস্ত টুথব্রুয়ািম হইয়া আসিয়া সেই সুরের সহিত আপনাকে মিলাইয়া লইতেছে—পুণাই সেই न९१ऊ: আমি কহিলাম— উৎসবমাত্রই তাই। মানুষ প্রতিদিন যে ভাবে কাজ করে, এক-একদিন তাহার উল্টা ভাবে আপনাকে সারিয়া লইতে চেষ্টা করে । প্রতিদিন উপার্জন করে, একদিন খরচ করে ; প্রতিদিন দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখে, একদিন দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দেয় ; প্রতিদিন গৃহের মধ্যে আমিই গৃহকর্তা, আর-একদিন আমি সকলের সেবায় নিযুক্ত । সেইদিন শুভদিন, আনন্দের দিন, সেইদিনই। উৎসব। সেইদিন সংবৎসরের আদর্শ। সেদিন ফুলের মালা, স্ফটিকের প্রদীপ, শোভন ভূষণ— এবং দূরে একটি বাঁশি বাজিয়া বলিতে থাকে, আজিকার এই সুরই যথার্থ সুর, আর-সমস্তই বেসুরা। বুঝিতে প্রতিদিনের দৈন্যবশত তাহা পারিয়া উঠি না ; যেদিন পারি। সেইদিনই প্ৰধান দিন । সমীর কহিল— সংসারে দৈন্যের শেষ নাই। সে দিক হইতে দেখিতে গেলে মানবজীবনটা অত্যন্ত