পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত ৮৯৩ : নহে । যেখানে আমরা কোনোরূপে অভিভূত নাহি বরং আমরাই যেখানে সবল পক্ষ সেখানেও আত্মীয়তা-স্থাপনের একটা চেষ্টা দেখিতে পাওয়া যায় । গাভীকে আমাদের দেশের লোক মা বলিয়া, ভগবতী বলিয়া, পূজা করে কেন ? সে তো অসহায় পশুমাত্র ; পীড়ন করিলে, তাড়না করিলে, তাহার হইয়া দু কথা বলিবার কেহ নাই। আমরা বলিষ্ঠ, সে দুর্বল ; আমরা মানুষ, সে পশু । কিন্তু আমাদের সেই শ্রেষ্ঠতাই আমরা গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছি। যখন তাহার নিকট হইতে উপকার গ্রহণ করিতেছি তখন যে সেটা বলপূর্বক করিতেছি, কেবল আমরা সক্ষম এবং সে নিরুপায় বলিয়াই করিতেছি, আমাদের অন্তরাত্মা সে কথা স্বীকার করিতে চাহে না । সে এই উপকারিণী পরম ধৈর্যবতী। প্রশান্তা পশুমাতাকে মা বলিয়া। তবেই ইহার দুগ্ধ পান করিয়া যথার্থ তৃপ্তি অনুভব করে ; মানুষের সহিত পশুর একটি ভাবের সম্পর্ক, একটি সৌন্দর্যের সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া। তবেই তাহার সৃজনচেষ্টা বিশ্রাম লাভ করে । ব্যোম গভীরভাবে কহিল- তুমি একটা খুব বড়ো কথা কহিয়াছ । শুনিয়া স্রোতস্বিনী চমকিয়া উঠিল । এমন দুষ্কর্ম কখন করিল সে জানিতে পারে নাই। এই অজ্ঞানকৃত অপরাধের জন্য সলজ সংকুচিত ভাবে সে নীরবে মার্জনা প্রার্থনা করিল। ব্যোম কহিল— ঐ যে আত্মার সৃজনচেষ্টার কথা উল্লেখ করিয়াছ উহার সম্বন্ধে অনেক কথা আছে । মাকড়সা যেমন মাঝখানে থাকিয়া চারি দিকে জাল প্রসারিত করিতে থাকে, আমাদের কেন্দ্ৰবাসী আত্মা সেইরূপ চারি দিকের সহিত আত্মীয়তাবন্ধন স্থাপনের জন্য ব্যস্ত আছে ; সে ক্ৰমাগতই বিসদৃশকে সদৃশ, দূরকে নিকট, পরকে আপনার করিতেছে। বসিয়া বসিয়া আত্ম-পরের মধ্যে সহস্ৰ সেতু নির্মাণ করিতেছে। ঐ যে আমরা যাহাকে সৌন্দর্য বলি সেটা তাহার নিজের সৃষ্টি । সৌন্দর্য আত্মার সহিত জড়ের মাঝখানকার সেতু । বস্তু কেবল পিণ্ডমাত্র ; আমরা তাহা হইতে আহার গ্রহণ করি, তাহাতে বাস করি, তাহার নিকট হইতে আঘাতও প্ৰাপ্ত হই । তাহাকে যদি পর বলিয়া দেখিতাম তবে বস্তুসমষ্টির মতো এমন পর আর কী আছে ? কিন্তু আত্মার কার্য আত্মীয়তা করা । সে মাঝখানে একটি সৌন্দর্য পাতাইয়া বসিল । সে যখন জড়কে বলিল সুন্দর, তখন সেও জড়ের অন্তরে প্ৰবেশ করিল, জড়ও তাহার অন্তরে আশ্রয় গ্রহণ করিল— সেদিন বড়োই পুলকের সঞ্চার হইল। এই সেতুনির্মাণকার্য এখনো চলিতেছে। কবির প্রধান গৌরব ইহাই । পৃথিবীতে চাবি দিকের সহিত সে আমাদের পুরাতন সম্বন্ধ দৃঢ় ও নব নব সম্বন্ধ আবিষ্কার করিতেছে। প্রতিদিন পর পৃথিবীকে আপনার এবং জড় পৃথিবীকে আত্মার বাসযোগ্য করিতেছে। বলা বাহুল্য, প্রচলিত ভাষায় যাহাকে জড় বলে আমিও তাহাকে জড় বলিতেছি । জড়ের জড়ত্ব সম্বন্ধে আমার মতামত ব্যক্ত করিতে বসিলে উপস্থিত সভায় সচেতন পদার্থের মধ্যে আমি একা মাত্র অবশিষ্ট থাকিব । * সমীর ব্যোমের কথায় বিশেষ মনোযোগ না করিয়া কহিল— স্রোতস্বিনী কেবল গাভীর দৃষ্টান্ত দিয়াছেন, কিন্তু আমাদের দেশে এ সম্বন্ধে দৃষ্টান্তের অভাব নাই। সেদিন যখন দেখিলাম এক ব্যক্তি রৌদ্রে তাতিয়া পুড়িয়া আসিয়া মাথা হইতে একটা কেরোসিন তেলের শূন্য টিনপাত্ৰ কুলে নামাইয়া “মা গো” বলিয়া জলে ঝাপ দিয়া পড়িল, মনে বড়ো একটু লাগিল। এই-যে স্নিগ্ধ সুন্দর সুগভীর জলরাশি সুমিষ্ট কলম্বরে দুই তীরকে স্তনদান করিয়া চলিয়াছে ইহারই শীতল ক্ৰোড়ে তাপিত শরীর সমর্পণ করিয়া দিয়া ইহাকে মা বলিয়া আহবান করা, অন্তরের এমন সুমধুর উচ্ছাস আর কি আছে ! এই ফলশস্যসুন্দরা বসুন্ধরা হইতে পিতৃপিতামহসেবিত আজন্মপরিচিত বাস্তুগৃহ পর্যন্ত যখন স্নেহসজীব আত্মীয়রূপে দেখা দেয়। তখন জীবন অত্যন্ত উর্বর সুন্দর শ্যামল হইয়া উঠে । তখন জগতের সঙ্গে সুগভীর যোগসাধন হয় ; জড় হইতে জন্তু এবং জন্তু হইতে মানুষ পর্যন্ত যে-একটি অবিচ্ছেদ্য ঐক্য আছে। এ কথা আমাদের কাছে অ’ বোধ হয় না ; কারণ, বিজ্ঞান এ কথার আভাস দিবার পূর্বে ਸਮੇਸ আমাদের ভাষায় ‘থ্যাঙ্ক শব্দের প্রতিশব্দ নাই বলিয়া কোনো কোনো যুরোপীয় পণ্ডিত সন্দেহ