পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br述)8 রবীন্দ্র-রচনাবলী করেন আমাদের কৃতজ্ঞতা নাই। কিন্তু আমি তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখিতে পাই। কৃতজ্ঞতা স্বীকার নিকট হইতে যাহা পাই, তাহাকেও আমরা স্নেহ-দয়া-উপকার -রূপে জ্ঞান করিয়া প্ৰতিদান দিবার জন্য ব্যগ্ৰ হই । যে জাতির লাঠিয়াল আপনার লাঠিকে, ছাত্র আপনার গ্ৰন্থকে এবং শিল্পী আপনার যন্ত্রকে কৃতজ্ঞতা-অৰ্পণ-লালসায় মনে মনে জীবন্ত করিয়া তোলে, একটা বিশেষ শব্দের অভাবে সে জাতিকে অকৃতজ্ঞ বলা যায় না । আমি কহিলাম— বলা যাইতে পারে। কারণ, আমরা কৃতজ্ঞতার সীমা লঙ্ঘন করিয়া চলিয়া গিয়াছি। আমরা যে পরস্পরের নিকট অনেকটা পরিমাণে সাহায্য অসংকোচে গ্রহণ করি অকৃতজ্ঞতা । তাহার কারণ নহে, পরস্পরের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যভাবের অপেক্ষাকৃত অভাবই তাহার প্রধান কারণ। ভিক্ষুক এবং দাতা, অতিথি এবং গৃহস্থ, আশ্রিত এবং আশ্রয়দাতা, প্ৰভু এবং ভূত্যের সম্বন্ধ যেন একটা স্বাভাবিক সম্বন্ধ । সুতরাং সে স্থলে কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ্যপূর্বক ঋণমুক্ত হইবার কথা কাহারও মনে উদয় श: न्पों | ব্যোম কহিল- বিলাতি হিসাবের কৃতজ্ঞতা আমাদের দেবতাদের প্রতিও নাই । যুরোপীয় যখন বলে “থ্যাঙ্ক গড' তখন তাহার অর্থ এই, ঈশ্বর যখন মনোযোগপূর্বক আমার একটা উপকার করিয়া দিলেন তখন সে উপকারটা স্বীকার না করিয়া বর্বরের মতো চলিয়া যাইতে পারি না । আমাদের দেবতাকে আমরা কৃতজ্ঞতা দিতে পারি না, কারণ, কৃতজ্ঞতা দিলে তাহাকে অল্প দেওয়া হয়, তাহাকে ফাকি দেওয়া হয় । তাহাকে বলা হয়, তোমার কাজ তুমি করিলে, আমার কর্তব্যও আমি সারিয়া দিয়া গেলাম । বরঞ্চ মেহের একপ্রকার অকৃতজ্ঞতা আছে, কারণ স্নেহের দাবির অন্ত নাই । সেই মেহের অকৃতজ্ঞতাও স্বাতন্ত্র্যের কৃতজ্ঞতা অপেক্ষা গভীরতর মধুরতর । রামপ্রসাদের গান আছে— তোমায় মা মা বলে আর ডাকব না | আমায় দিয়েছ দিতেছ। কত যন্ত্রণা | এই উদার অকৃতজ্ঞতা কোনো য়ুরোপীয় ভাষায় তর্জমা হইতে পারে না । ক্ষিতি কটাক্ষসহকারে কহিল— য়ুরোপীয়দের প্রতি আমাদের যে অকৃতজ্ঞতা, তাহারও বোধ হয় একটা গভীর এবং উদার কারণ কিছু থাকিতে পারে। জড়প্রকৃতির সহিত আত্মীয়সম্পর্ক স্থাপন সম্বন্ধে যে কথাগুলি হইল তাহা সম্ভবত অত্যন্ত সুন্দর ; এবং গভীর যে, তাহার। আর সন্দেহ নাই, কারণ, এ পর্যন্ত আমি সম্পূর্ণ তলাইয়া উঠিতে পারি নাই | সকলেই তো একে একে বলিলেন যে, আমরাই প্রকৃতির সহিত ভাবের সম্পর্ক পাতাইয়া বসিয়াছি আর যুরোপ তাহার সহিত দূরের লোকের মতো ব্যবহার করে । কিন্তু জিজ্ঞাসা করি। যদি যুরোপীয় সাহিত্য, ইংরাজি কাব্য আমাদের না জানা থাকিত, তবে আজিকার সভায় এ আলোচনা কি সম্ভব হইত ? এবং যিনি ইংরাজি কখনাে পড়েন নাই তিনি কি শেষ পর্যন্ত ইহার মর্মগ্রহণ করিতে পরিবেন ? আমি কহিলাম— না, কখনোই না । তাহার একটু কারণ আছে। প্রকৃতির সহিত আমাদের যেন ভাইবোনের সম্পর্ক এবং ইংরাজ ভাবুকের যেন স্ত্রীপুরুষের সম্পর্ক । আমরা জন্মাবধিই আত্মীয়, আমরা স্বভাবতই এক। আমরা তাহার মধ্যে নব নব বৈচিত্ৰ্য, পরিসূক্ষ্ম ভাবচ্ছায়া দেখিতে পাই না, একপ্রকার অন্ধ অচেতন স্নেহে মাখামাখি করিয়া থাকি। আর ইংরাজ, প্রকৃতির বাহির হইতে অন্তরে প্রবেশ করিতেছে । সে আপনার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়াছে বলিয়াই তাহার পরিচয় এমন অভিনব আনন্দময়, তাহার মিলন এমন প্রগাঢ়তর। সেও নববধূর ন্যায় প্রকৃতিকে আয়ত্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে, প্রকৃতিও তাহার মনোহরণের জন্য আপনার নিগুঢ় সৌন্দর্য উদঘাটিত করিতেছে। সে প্রথমে প্রকৃতিকে জড় বলিয়া জানিত, হঠাৎ একদিন যেন যৌবনারম্ভে তাহার প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া তাহার অনির্বচনীয় অপরিমেয় আধ্যাত্মিক সৌন্দৰ্য আবিষ্কার করিয়াছে। আমরা আবিষ্কার করি নাই, কারণ, আমরা সন্দেহও করি নাই, প্রশ্নও করি নাই । . আত্মা অন্য আত্মার সংঘর্ষে তবেই আপনাকে সম্পূর্ণরূপে অনুভব করিতে পারে, তবেই সে মিলনের