পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত brsの আধ্যাত্মিকতা পরিপূর্ণ মাত্রায় মস্থিত হইয়া উঠে । একাকার হইয়া থাকা কিছু না থাকার ঠিক পরেই। কোনো একজন ইংরাজ কবি লিখিয়াছেন, ঈশ্বর আপনারই পিতৃ-অংশ এবং মাতৃ-অংশকে স্ত্রীপুরুষরূপে পৃথিবীতে ভাগ করিয়া দিয়াছেন ; সেই দুই বিচ্ছিন্ন অংশ এক হইবার জন্য পরস্পরের প্রতি এমন অনিবাৰ্য আনন্দে আকৃষ্ট হইতেছে ; কিন্তু এই বিচ্ছেদটি না হইলে পরস্পরের মধ্যে এমন প্রগাঢ় পরিচয় হইত না । ঐক্য অপেক্ষা মিলনেই আধ্যাত্মিকতা অধিক । আমরা পৃথিবীকে নদীকে মা বলি, আমরা ছায়াময় বট-অশ্বখকে পূজা করি, আমরা প্রস্তর-পাষাণকে সজীব করিয়া দেখি, কিন্তু আত্মার মধ্যে তাহার আধ্যাত্মিকতা অনুভব করি না । বরঞ্চ আধ্যাত্মিককে বাস্তবিক করিয়া তুলি । আমরা তাহাতে মনঃকল্পিত মূর্তি আরোপ করি, আমরা তাহার নিকট সুখ সম্পদ সফলতা প্রার্থনা করি । কিন্তু আধ্যাত্মিক সম্পর্ক কেবলমাত্র সৌন্দর্য কেবলমাত্র আনন্দের সম্পর্ক, তাহা সুবিধা-অসুবিধা সঞ্চয়-অপচয়ের সম্পর্ক নহে। মোহসৌন্দর্যপ্রবাহিণী জাহ্নবী যখন আত্মার আনন্দ দান করে তখনই সে আধ্যাত্মিক ; কিন্তু যখনই তাহাকে মূর্তিবিশেষে নিবদ্ধ করিয়া তাহার নিকট হইতে ইহকাল অথবা পরকালের কোনাে বিশেষ সুবিধা প্রার্থনা করি তখন তাহা সৌন্দর্যহীন মোহ, অন্ধ অজ্ঞানতা মাত্র । তখনই আমরা দেবতাকে পুত্তলিকা করিয়া দিই । ইহঁকালের সম্পদ এবং পরকালের পুণ্য, হে জাহ্নবী, আমি তোমার নিকট চাহি না এবং চাহিলেও পাইব না, কিন্তু শৈশবকাল হইতে জীবনের কত দিন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে, কৃষ্ণপক্ষের অর্ধচন্দ্রালোকে, ঘনবর্ষার মেঘশ্যামল মধ্যাহ্নে, আমার অন্তরাত্মাকে যে-এক অবর্ণনীয় অলৌকিক পুলকে পরিপূর্ণ করিয়া দিয়াছ সেই আমার দুর্লভ জীবনের আনন্দসঞ্চয়গুলি যেন জন্মজন্মান্তরে অক্ষয় হইয়া থাকে ; পৃথিবী হইতে সমস্ত জীবন যে, নিরুপম সৌন্দর্য চয়ন করিতে পারিয়াছি। যাইবার সময় যেন একখানি পূৰ্ণশতদলের মতো সেটি হাতে করিয়া লইয়া যাইতে পারি এবং যদি আমার প্রিয়তমের সহিত সাক্ষাৎ হয় তবে তাহার করপল্লবে সমর্পণ করিয়া দিয়া একটি বারের মানবজন্ম কৃতাৰ্থ করিতে পারি। V S \o O নরনারী সমীর এক সমস্যা উত্থাপিত করিলেন, তিনি বলিলেন- ইংরাজি সাহিত্যে গদ্য অথবা পদ্য কাব্যে নায়ক এবং নায়িকা উভয়েরই মাহাত্ম্য পরিস্ফুট হইতে দেখা যায়। ডেসডিমোনার নিকট ওথেলো এবং ইয়াগো কিছুমাত্ৰ হীনপ্রভ নহে ; ক্লিয়োপাট্রা আপনার শ্যামল বঙ্কিম বন্ধনজালে অ্যান্টনিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে বটে, কিন্তু তথাপি লতাপাশবিজড়িত ভগ্ন জয়স্তম্ভের ন্যায় অ্যাণ্টনির উচ্চতা সর্বসমক্ষে দৃশ্যমান রহিয়াছে। লামারমুরের নায়িকা আপনার সকরুণ সরল সুকুমার সৌন্দর্যে যতই আকর্ষণ করিয়া লইতে পারে না । কিন্তু বাংলা সাহিত্যে দেখা যায় নায়িকারই প্রাধান্য । কুন্দনন্দিনী এবং সূর্যমুখীর নিকট নগেন্দ্ৰ স্নান হইয়া আছে, রোহিণী এবং ভ্রমরের নিকট গোবিন্দলাল অদৃশ্যপ্রায়, জ্যোতির্ময়ী কপালকুণ্ডলার পার্থে নবকুমার ক্ষীণতম উপগ্রহের ন্যায়। প্রাচীন বাংলা কাব্যেও দেখো । বিদ্যাসুন্দরের মধ্যে সজীব মূর্তি যদি কাহারও থাকে। তবে সে কেবল বিদ্যার ও মালিনীর, সুন্দরচরিত্রে পদার্থের লেশমাত্র নাই। কবিকঙ্কণ চণ্ডীর সুবৃহৎ সমভূমির মধ্যে কেবল ফুল্লরা এবং খুল্পনা এ নড়িয়া বেড়ায়, নতুবা ব্যাধটা একটা বিকৃত বৃহৎ স্থাণুমাত্র এবং ধনপতি ও র্তাহার পুত্র কোনো কাজের নহে। বঙ্গসাহিত্যে পুরুষ মহাদেবের ন্যায় নিশ্চল ভাবে ধূলিশয়ান এবং রমণী তাহার বক্ষের উপর জাগ্ৰত জীবন্ত ভাবে বিরাজমান । ইহার কারণ কী ? w সমীরের এই প্রশ্নের উত্তর শুনিবার জন্য স্রোতস্বিনী অত্যন্ত কৌতুহলী হইয়া উঠিলেন এবং দীপ্তি দুস্থত মনােযোগের ভান করিয়া টেবিলের উপর একটা গ্রন্থ বুলিয়া তাহার প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করিয়া রাখলেন ।