পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত bra)" ব্যোম কহিলেন- স্ত্রীলোকেরা আপনার কর্মবন্ধনে আপনি বদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে। জ্বলন্ত অঙ্গর যেমন আপনার ভস্ম। আপনি সঞ্চয় করে, নারী তেমনি আপনার স্তৃপাকার কার্যাবশেষের দ্বারা আপনাকে নিহিত করিয়া ফেলে— সেই তাহার অন্তঃপুর, তাহার চারি দিকে কোনো অবসর নাই । তাহাকে যদি ভস্মমুক্ত করিয়া বহিঃসংসারের কার্যরাশির মধ্যে নিক্ষেপ করা যায়। তবে কি কম কাণ্ড হয় ! পুরুষের সাধ্য কী তেমন দ্রুতবেগে তেমন তুমুল ব্যাপার করিয়া তুলিতে ! পুরুষের কাজ করিতে বিলম্ব হয় ; সে এবং তাহার কার্যের মাঝখানে একটা দীর্ঘ পথ থাকে, সে পথ বিস্তর চিন্তার দ্বারা আকীর্ণ। রমণী যদি একবার বহির্বিপ্লবে যোগ দেয়, নিমেষের মধ্যে সমস্ত ধুধু করিয়া উঠে। এই প্ৰলয়কারিণী কাৰ্যশক্তিকে সংসার বাধিয়া রাখিয়াছে, এই অগ্নিতে কেবল শয়নগৃহের সন্ধ্যাদীপ জ্বলিতেছে, শীতার্ত প্ৰাণীর শীত নিবারণ ও ক্ষুধার্ত প্রাণীর অন্ন প্ৰস্তুত হইতেছে। যদি আমাদের সাহিত্যে এই সুন্দরী বহ্নিশিখাগুলির তেজ দীপ্যমান হইয়া থাকে। তবে তাহা লইয়া এত তর্ক কিসের জন্য ! আমি কহিলাম— আমাদের সাহিত্যে স্ত্রীলোক যে প্রাধান্য লাভ করিয়াছে তাহার প্রধান কারণ, আমাদের দেশের স্ত্রীলোক আমাদের দেশের পুরুষের অপেক্ষা অনেক শ্রেষ্ঠ । স্রোতস্বিনীর মুখ ঈষৎ রক্তিম এবং সহাস্য হইয়া উঠিল। দীপ্তি কহিল— এ! আবার তোমার বাডবাডি । বুঝিলাম দীপ্তির ইচ্ছা, আমাকে প্রতিবাদ করিয়া স্বজাতির গুণগান বেশি করিয়া শুনিয়া লইবে । আমি তাহাকে সে কথা বলিলাম, এবং কহিলাম স্ত্রীজাতি স্তুতিবাক্য শুনিতে অত্যন্ত ভালোবাসে । দীপ্তি সবলে মাথা নাড়িয়া কহিল- কখনোই না । স্রোতস্বিনী মৃদুভাবে কহিল— সে কথা সত্য । অপ্রিয় বাক্য আমাদের কাছে অত্যন্ত অধিক অপ্রিয় এবং প্রিয় বাক্য আমাদের কাছে বড়ো বেশি মধুর । স্রোতস্বিনী রমণী হইলেও সত্য কথা স্বীকার করিতে কুষ্ঠিত হয় না । , আমি কহিলাম— তাহার একটু কারণ আছে। গ্রন্থকারদের মধ্যে কবি এবং গুণীদের মধ্যে গায়কগণ বিশেষরূপে স্তুতিমিষ্টান্নপ্ৰিয় । আসল কথা, মনোহরণ করা যাহাদের কাজ, প্ৰশংসাই তাহাদের কৃতকার্যতা পরিমাপের একমাত্র উপায়। অন্য সমস্ত কাৰ্য্যফলের নানারূপ প্রত্যক্ষ প্রমাণ । আছে, স্তুতিবাদলাভ ছাড়া মনোরঞ্জনের আর কোনো প্ৰমাণ নাই । সেইজন্য গায়ক প্রত্যেকবার সমের কাছে আসিয়া বাহবা প্ৰত্যাশা করে । সেইজন্য অনাদর গুণীমাত্রের কাছে এত অধিক অপ্রীতিকর । সমীর কহিলেন- কেবল তাহাই নয়, নিরুৎসাহ মনোহরণকার্যের একটি প্রধান অন্তরায় । শ্রোতার মনকে অগ্রসর দেখিলে তবেই গায়কের মন আপনার সমস্ত ক্ষমতা বিকশিত করিতে পারে । অতএব স্তুতিবাদ শুদ্ধ যে তাহার পুরস্কার তাহা নহে, তাহার কার্যসাধনের একটি প্রধান অঙ্গ । আমি কহিলাম- স্ত্রীলোকেরও প্রধান কাৰ্য আনন্দদান করা । তাহার সমস্ত অস্তিত্বকে সংগীত ও কবিতার ন্যায় সম্পূর্ণ সৌন্দর্যময় করিয়া তুলিলে তবে তাহার জীবনের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। সেইজন্যই স্ত্রীলোক স্তুতিবাদে বিশেষ আনন্দলাভ করে। কেবল অহংকার-পরিতৃপ্তির জন্য নহে; তাহাতে সে আপনার জীবনের সার্থকতা অনুভব করে । ত্রুটি-অসম্পূর্ণতা দেখাইলে একেবারে তাহাদের মর্মের মূলে গিয়া আঘাত করে। এইজন্য লোকনিন্দা স্ত্রীলোকের নিকট বড়ো ভয়ানক । ক্ষিতি কহিলেন- তুমি যাহা বলিলে দিব্য কবিত্ব করিয়া বলিলে, শুনিতে বেশ লাগিল, কিন্তু আসল কথাটা এই যে, স্ত্রীলোকের কার্যের পরিসর সংকীর্ণ। বৃহৎ দেশে ও বৃহৎ কালে তাহার স্থান নাই। উপস্থিতমত স্বামীপুত্ৰ-আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীদিগকে সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত করিতে পারিলেই তাহার কর্তব্য সাধিত হয়। যাহার জীবনের কার্যক্ষেত্র দূরদেশ ও দূরকালে বিস্তীর্ণ, যাহার কর্মের ফলাফল সকল সময় আশু প্ৰত্যক্ষগোচর নহে, নিকটের লোকের ও বর্তমান কালের নিন্দাস্তুতির উপর তাহার তেমন একান্ত নির্ভর নহে ; সুদূর আশা ও বৃহৎ কল্পনা, অনাদর উপেক্ষা ও নিন্দার মধ্যেও তাঁহাকে অবিচলিত বল প্ৰদান করিতে পারে । লোকনিন্দ লোকন্তুতি সৌভাগ্যগর্ব এবং মান-অভিমানে S |ዘ(ሱ ዒ