পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brsbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী স্ত্রীলোককে যে এমন বিচলিত করিয়া তোলে তাহার প্রধান কারণ, জীবন লইয়া তাহাদের নগদ কারবার, তাহাদের সমুদায় লাভ-লোকসান বর্তমানে ; হাতে হাতে যে ফল প্রাপ্ত হয় তাহাই তাহাদের একমাত্র পাওনা ; এইজন্য তাহারা কিছু কষাকষি করিয়া আদায় করিতে চায়, এক কানাকড়ি ছাড়িতে দীপ্তি বিরক্ত হইয়া যুরোপ ও আমেরিকার বড়ো বড়ো বিশ্বহিতৈষিণী রমণীর দৃষ্টান্ত অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। স্রোতস্বিনী কহিলেন— বৃহত্ত্ব ও মহত্ত্ব সকল সময়ে এক নহে। আমরা বৃহৎ ক্ষেত্রে কার্য করি না বলিয়া আমাদের কার্যের গৌরব অল্প এ কথা আমি কিছুতেই মনে করিতে পারি না । পেশী স্নায়ু অস্থিচর্ম বৃহৎ স্থান অধিকার করে, মর্মস্থানটুকু অতি ক্ষুদ্র এবং নিভৃত । আমরা সমস্ত মানবসমাজের সেই মর্মকেন্দ্রে বিরাজ করি । পুরুষ-দেবতাগণ বৃষ মহিষ প্রভৃতি বলবান পশুবাহন আশ্রয় করিয়া ভ্ৰমণ করেন ; স্ত্রী-দেবীগণ হৃদয়শতদলবাসিনী, তাহারা একটি বিকশিত ধ্রুব সৌন্দর্যের মাঝখানে পরিপূর্ণ মহিমায় সমাসীন। পৃথিবীতে যদি পুনর্জন্মলাভ করি তবে আমি যেন পুনর্বার নারী হইয়া জন্মগ্রহণ করি। যেন ভিখারি না হইয়া, অন্নপূর্ণ হই। একবার ভাবিয়া দেখো সমস্ত মানবসংসারের মধ্যে প্রতিদিবসের রোগশোক ক্ষুধাশ্ৰান্তি কত বৃহৎ, প্ৰতিমুহূর্তে কর্মচক্রোৎক্ষিপ্ত ধূলিরাশি। কত স্তৃপাকার হইয়া উঠিতেছে ; প্রতি গৃহের রক্ষাকার্য কত অসীমগ্ৰীতিসাধ্য ; যদি কোনাে প্ৰসন্নমূর্তি প্ৰফুল্লমুখী ধৈর্যময়ী লোকবৎসল দেবী প্রতিদিবসের শিয়রে বাস করিয়া তাহার তপ্ত ললাটে স্নিগ্ধ স্পর্শ দান করেন, আপনার কার্যকুশল সুন্দর হস্তের দ্বারা প্রত্যেক মুহূর্ত হইতে তাহার মলিনতা অপনয়ন করেন এবং প্রত্যেক গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া অশ্রান্ত স্নেহে তাহার কল্যাণ ও শান্তি বিধান করিতে থাকেন, তবে তাহার কার্যস্থল সংকীর্ণ বলিয়া তাহার মহিমা কে অস্বীকার করিতে পারে ? যদি সেই লক্ষ্মীমূর্তির আদর্শখানি হৃদয়ের মধ্যে উজ্জ্বল করিয়া রাখি, তবে নারীজন্মের প্রতি আর অনাদর জন্মিতে পারে না। ইহার পর আমরা সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম। এই অকস্মাৎ নিস্তব্ধতায় স্রোতস্বিনী অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া উঠিয়া আমাকে বলিলেন— তুমি আমাদের দেশের স্ত্রীলোকের কথা কী বলিতেছিলে— মাঝে হইতে অন্য তর্ক আসিয়া সে কথা চাপা পড়িয়া গেল । অনেক শ্রেষ্ঠ । ক্ষিতি কহিলেন- তাহার প্রমাণ ? - আমি কহিলাম- প্ৰমাণ হাতে হাতে । প্ৰমাণ ঘরে ঘরে | প্ৰমাণ অন্তরের মধ্যে । পশ্চিমে ভ্ৰমণ করিবার সময় কোনো কোনো নদী দেখা যায়, যাহার অধিকাংশে তপ্ত শুষ্ক বালুকা ধু ধূ করিতেছে— কেবল এক পার্শ্ব দিয়া স্ফটিকস্বচ্ছসলিলা স্নিগ্ধ নদীটি অতি নম্রমধুর স্রোতে প্রবাহিত হইয়া যাইতেছে। সেই দৃশ্য দেখিলে আমাদের সমাজ মনে পড়ে। আমরা অকৰ্মণ্য, নিস্ফল নিশ্চল বালুকারাশি স্তৃপকার হইয়া পড়িয়া আছি, প্রত্যেক সমীরাশ্বাসে তুহু করিয়া উড়িয়া যাইতেছি এবং যে-কোনো কীর্তিস্তম্ভ নির্মাণ করিবার চেষ্টা করিতেছি। তাঁহাই দুই দিনে ধসিয়া ধসিয়া পড়িয়া যাইতেছে। আর আমাদের বাম পার্থে আমাদের রমণীগণ নিম্নপথ দিয়া বিনম্র সেবিকার মতো আপনাকে সংকুচিত করিয়া স্বচ্ছ সুধাস্রোতে প্রবাহিত হইয়া চলিতেছে। তাহাদের এক মুহুর্ত বিরাম নাই। তাহাদের গতি, তাহাদের প্রীতি, তাহাদের সমস্ত জীবন, এক ধ্রুব লক্ষ্য ধরিয়া অগ্রসর হইতেছে। আমরা লক্ষ্যহীন, ঐক্যহীন, সহস্রপদতলে দলিত হইয়াও মিলিত হইতে অক্ষম । যে দিকে জলস্রোত, যে দিকে আমাদের নারীগণ, কেবল সেই দিকে সমস্ত শোভা এবং ছায়া এবং সফলতা, এবং যে দিকে আমরা সে দিকে কেবল মরুচাকচিক্য, বিপুল শূন্যতা এবং দগ্ধ দাস্যবৃত্তি। সমীর, তুমি কী বল ? সমীর স্রোতস্বিনী ও দীপ্তির প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া হাসিয়া কহিলেন- আদ্যকার সভায় নিজেদের অসারতা স্বীকার করিবার দুইটি মূর্তিমতী বাধা বর্তমান। আমি তাহাদের নাম করিতে চাহি না । বিশ্বসংসারের মধ্যে বাঙালি পুরুষের আদর কেবল আপন অন্তঃপুরের মধ্যে। সেখানে তিনি