পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত 述)の> দীপ্তি ও স্রোতস্বিনী সভা ছাড়িয়া গেলে ক্ষিতি হীপ ছাড়িয়া কহিল— এইবার সত্য কথা বলিবার সময় পাইলাম। বাতাসটা এইবার মোহমুক্ত হইবে । তোমাদের কথাটা অত্যক্তিতে বড়ো, আমি তাহা নীরবে সহ্য করিয়াছি ; আমার কথাটা লম্বায় যদি বড়ো হয় সেটা তোমাদের সহ্য করিতে হইবে । আমাদের সভাপতি মহাশয় সকল বিষয়ের সকল দিক দেখিবার সাধনা করিয়া থাকেন এইরূপ র্তাহার নিজের ধারণা। এই গুণটি যে সদগুণ আমার তাঁহাতে সন্দেহ আছে। ওকে বলা যায় বুদ্ধির পেটুকতা । লোভ সংবরণ করিয়া যে মানুষ বাদ-সাদ দিয়া বাছিয়া খাইতে জানে সেই যথার্থ খাইতে পারে । আহারে যাহার পক্ষপাতের সংযম আছে সেই করে স্বাদগ্ৰহণ, এবং ধারণ করে সম্যকরূপে | বুদ্ধির যদি কোনো পক্ষপাত না থাকে, যদি বিষয়ের সবটাকেই গিলিয়া ফেলার কুশ্ৰী অভ্যাস তাহার থাকে, তবে সে বেশি পায় কল্পনা করিয়া আসলে কম পায় । যে মানুষের বুদ্ধি সাধারণত অতিরিক্ত পরিমাণে অপক্ষপাতী সে যখন বিশেষ ক্ষেত্রে পক্ষপাতী হইয়া পড়ে তখন একেবারে আত্মবিস্মৃত হইতে থাকে, তখন তার সেই অমিতাচারে ধৈর্য রক্ষা করা কঠিন হয় । সভাপতি মহাশয়ের একমাত্র পক্ষপাতের বিষয় নারী । সে সম্বন্ধে তাহার অতিশয়োক্তি মনের স্বাস্থ্যরক্ষার প্রতিকুল এবং সত্যবিচারের বিরোধী । পুরুষের জীবনের ক্ষেত্র বৃহৎ সংসারে, সেখানে সাধারণ মানুষের ভুলচুক-ত্রুটি পরিমাণে বেশি হইয়াই থাকে । বৃহতের উপযুক্ত শক্তি সাধনাসাপেক্ষ, কেবলমাত্র সহজ বুদ্ধির জোরে সেখানে ফল পাওয়া যায় না । স্ত্রীলোকের জীবনের ক্ষেত্র ছোটাে সংসারে, সেখানে সহজ বুদ্ধিই কাজ চালাইতে পারে । সহজ বুদ্ধি জৈব অভ্যাসের অনুগামী, তাহার অশিক্ষিতপটুত্ব— তাই বলিয়াই সে সুশিক্ষিত-পটুত্বের উপরে বাহাদুরি লইবে এ তো সহ্য করা চলে না । ক্ষুদ্র সীমার মধ্যে যাহা সহজে সুন্দর তার চেয়ে বড়ো জাতের সুন্দর তাঁহাই— বৃহৎ সীমায় যুদ্ধের ক্ষতচিহ্নে যাহা চিহ্নিত, অসুন্দরের সংঘর্ষে ও সংযোগে যাহা কঠিন, যাহা অতিসৌষম্যে অতিললিত অতিনিখুঁত নয় । দেশের পুরুষদের প্রতি তোমরা যে ঐকান্তিক ভাবে অবিচার করিয়ােছ তাহাকে আমি ধিককার দিই, তাহার অমিতভাষণেই প্রমাণ হয় তাহার অমূলকতা । পৃথিবীতে কাপুরুষ অনেক আছে, আমাদের দেশে হয়তো বা সংখ্যায় আরো বেশি। তার প্রধান কারণটার আভাস পূর্বেই দিয়াছি। যথার্থ পুরুষ হওয়া সহজ নয়, তাহা দুমূল্য বলিয়াই দুর্লভ । আদর্শ নারীর উপকরণ-আয়োজন অনেকখানিই জোগাইয়াছে প্রকৃতি । প্রকৃতির আদুরে সন্তান নয়। পুরুষ, বিশ্বের শক্তিভাণ্ডার তাহাকে লুঠ করিয়া লাইতে হয় । এইজন্য পৃথিবীতে অনেক পুরুষ অকৃতাৰ্থ । কিন্তু যাহারা সার্থক হইতে পারে তাঁহাদের তুলনা তোমার মেয়েমহলে মিলিবে কোথায়, অন্তত আমাদের দেশে এই অকৃতাৰ্থতার কি একটা কারণ নয় মেয়েরাই ? তাহাদের অন্ধসংস্কার, তাহাদের আসক্তি, তাহাদের ঈর্ষা, তাহাদের কৃপণতা ! মেয়েরা সেখানেই ত্যাগ করে যেখানে তাহাদের প্রবৃত্তি ত্যাগ করায়, তাহাদের সন্তানের জন্য, প্রিয়জনের জন্য । পুরুষের যথার্থ ত্যাগের ক্ষেত্র প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে। এ কথা মনে রাখিয়া দুই জাতের তুলনা করিয়ো । স্ত্রৈণকে মনে মনে স্ত্রীলোক পরিহাস করে, জানে সেটা মোহ, সেটা দুর্বলতা । একান্তমনে আশা করি দীপ্তি ও স্রোতস্বিনী তোমাদের বাড়াবাড়ি লইয়া উচ্চহাসি হাসিতেছে ; না। যদি হাসে তবে তাহাদের পরে আমার শ্রদ্ধা থাকিবে না । তাহারা নিজের স্বভাবের সীমা কি নিজেরাও জানে না ? পরকে ভোলাইবার জন্য অহংকার মার্জনীয়, কিন্তু সেইসঙ্গে মনে মনে চাপা হাসি হাসা দরকার । নিজেকে ভোলাইবার জন্য যাহারা অপরিমিত অহংকার অবিচলিত গাম্ভীর্যের সহিত আত্মসাৎ করিতে পারে, তাহারা যদি স্ত্রীজাতীয় হয় তবে বলিতে হইবে মেয়েদের হাস্যতাবোধ নাই- সেটাই হসনীয়, এমন-কি, শোচনীয়। স্বর্গের দেবীরা স্তবের কোনো অতিভাষণে কুষ্ঠিত হন না, আমাদের মর্তের দেবীদেরও যদি সেই গুণটি থাকে। তবে তাহদের দেবী উপাধি কেবলমাত্র সেই কারণেই সার্থক । তার পরে একটা কথা বলিতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু তোমাদের আলোচনার ওজন রক্ষার জন্য বলা দরকার। মেয়েদের ছােটাে সংসারে সর্বত্রই অথবা প্রায় সর্বত্রই যে মেয়েরা লক্ষ্মীর আদর্শ এ কথা যদি