পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত δO \Ο এ-সমস্ত কথা সম্পূর্ণরূপে পর্যালোচনা করিয়াও আমার মনের মধ্যে একটি দৈববাণী ধ্বনিত হইতে লাগিল— তবু এই নির্বোধি সরল মানুষগুলি কেবল ভালোবাসা নহে, শ্রদ্ধার যোগ্য। কেন আমি ইহাদিগকে শ্রদ্ধা করি তাই ভাবিয়া দেখিতেছিলাম। দেখিলাম ইহাদের মধ্যে যে-একটি সরল বিশ্বাসের ভাব আছে তাহা অত্যন্ত বহুমূল্য । এমন-কি, তাহাই মনুষ্যত্বের চিরসাধনার ধন । যদি মনের ভিতরকার কথা খুলিয়া বলিতে হয় তবে এ কথা স্বীকার করিব আমার কাছে তাহা অপেক্ষা মনোহর আর কিছু নাই । সেই সরলতাটুকু চলিয়া গেলে সভ্যতার সমস্ত সৌন্দৰ্য্যটুকু চলিয়া যায়। কারণ, স্বাস্থ্য চলিয়া যায়। সরলতাই মনুষ্যপ্রকৃতির স্বাস্থ্য । যতটুকু আহার করা যায় ততটুকু পরিপাক হইলে শরীরের স্বাস্থ্যরক্ষা হয় । মসলা দেওয়া ঘূতপক সুস্বাদু চৰ্য্যচােষ্যলেহ্য পদার্থকে স্বাস্থ্য বলে না। সমস্ত জ্ঞান ও বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ পরিপাক করিয়া স্বভাবের সহিত একীভূত হইয়া লওয়ার অবস্থাকেই বলে সরলতা, তাহাই মানসিক স্বাস্থ্য । বিবিধ জ্ঞান ও বিচিত্ৰ মতামতকে মনের স্বাস্থ্য <(ळला कीं । এখানকার এই নির্বোধি গ্রাম্য লোকেরা যে-সকল জ্ঞান ও বিশ্বাস লইয়া সংসারযাত্ৰা নির্বাহ করে, সে সমস্তই ইহাদের প্রকৃতির সহিত এক হইয়া মিশিয়া গেছে। যেমন নিশ্বাসপ্রশ্বাস রক্ত-চলাচল আমাদের হাতে নাই, তেমনি এ-সমস্ত মতামত রাখা-না-রাখা তাহাদের হাতে নাই । তাহারা যাহা-কিছু জানে, সহিত, বিশ্বাসের সহিত, কাজের সহিত, মানুষের সহিত এক হইয়া গিয়াছে। একটা উদাহরণ দিই। অতিথি ঘরে আসিলে ইহারা তাহাকে কিছুতেই ফিরায় না। আন্তরিক ভক্তির সহিত অক্ষুন্নমনে তাহার সেবা করে । সেজন্য কোনো ক্ষতিকে ক্ষতি, কোনো ক্লেশকে ক্লেশ বলিয়া তাহাদের মনে উদয় হয় না । আমিও আতিথ্যকে কিয়ৎপরিমাণে ধর্ম বলিয়া জানি ; কিন্তু তাহাও জ্ঞানে জানি, বিশ্বাসে জানি না । অতিথি দেখিবামাত্র আমার সমস্ত চিত্তবৃত্তি তৎক্ষণাৎ তৎপর হইয়া আতিথ্যের দিকে ধাবমান হয় না । মনের মধ্যে নানারূপ তর্ক ও বিচার করিয়া থাকি । এ সম্বন্ধে কোনো বিশ্বাস আমার প্রকৃতির সহিত এক হইয়া যায় নাই । কিন্তু স্বভাবের ভিন্ন ভিন্ন অংশের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য ঐক্যই মনুষ্যত্বের চরম লক্ষ্য । নিম্নতম জীবশ্রেণীর মধ্যে দেখা যায়, তাহাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছেদন করিলেও, তাহাদিগকে দুই-চারি অংশে বিভক্ত করিলেও, কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না ; কিন্তু জীবগণ যতই উন্নতিলাভ করিয়াছে ততই তাঁহাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে ঘনিষ্ঠতর ঐক্য স্থাপিত হইয়াছে । মানবস্বভাবের মধ্যেও জ্ঞান বিশ্বাস ও কার্যের বিচ্ছিন্নতা উন্নতির নিম্নপর্যয়গত । তিনের মধ্যে অভেদ সংযোগই চরম উন্নতি । কিন্তু যেখানে জ্ঞান বিশ্বাস কার্যের বৈচিত্ৰ্য নাই সেখানে এই ঐক্য অপেক্ষাকৃত সুলভ ।। ফুলের পক্ষে সুন্দর হওয়া যত সহজ জীবশরীরের পক্ষে তত নহে। জীবদেহের বিবিধকার্যোপযোগী বিচিত্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-সমাবেশের মধ্যে তেমন নিখুঁত সম্পূর্ণতা বড়ো দুর্লভ। জন্তুদের অপেক্ষা মানুষের মধ্যে সম্পূর্ণতা আরো দুর্লভ। মানসিক প্রকৃতি সম্বন্ধেও এ কথা খাটে । আমার এই ক্ষুদ্র গ্রামের চাষীদের প্রকৃতির মধ্যে যে-একটি ঐক্য দেখা যায় তাহার মধ্যে বৃহত্ত্ব জটিলতা কিছুই নাই। এই ধরাপ্রান্তে ধান্যক্ষেত্রের মধ্যে সামান্য গুটিকতক অভাব মোচন করিয়া জীবনধারণ করিতে অধিক দর্শন বিজ্ঞান সমাজতত্ত্বের প্রয়োজন হয় না । যে-গুটিকয়েক আদিম পরিবারনীতি গ্রামনীতি এবং প্ৰজানীতির আবশ্যক, সে-কয়েকটি অতিসহজেই মানুষের জীবনের সহিত মিশিয়া অখণ্ড জীবন্তভােব ধারণ করিতে পারে । তবু, ক্ষুদ্র হইলেও ইহার মধ্যে যে-একটি সৌন্দর্য আছে তাহা চিত্তকে আকর্ষণ না করিয়া থাকিতে পারে না, এবং এই সৌন্দর্যটুকু অশিক্ষিত ক্ষুদ্র গ্রামের মধ্য হইতে পদ্মের ন্যায় উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিয়া