পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত | O ۹ আবার কহিলাম— তুমি জীবন্ত বর্তমান, প্রতিক্ষণে নব নব ভাবে আপনাকে ব্যক্ত করিতেছ— তুমি যে আছ, তুমি যে সত্য, তুমি যে সুন্দর, এ বিশ্বাস উদ্রেক করিবার জন্য তোমাকে কোনো চেষ্টাই করিতে হইতেছে না । কিন্তু লেখায় সেই প্ৰথম সত্যটুকু প্ৰমাণ করিবার জন্য অনেক উপায় অবলম্বন এবং অনেক বাক্য ব্যয় করিতে হয়। নতুবা প্রত্যক্ষের সহিত অপ্রত্যক্ষ সমকক্ষত রক্ষা করিতে পরিবে কেন ? তুমি যে মনে করিতেছ। আমি তোমাকে বেশি বলাইয়াছি তাহা ঠিক নহে, আমি বরং তোমাকে সংক্ষেপ করিয়া লইয়াছি— তোমার লক্ষ লক্ষ কথা, লক্ষ লক্ষ কাজ, চিরবিচিত্ৰ আকার-ইঙ্গিতে কেবলমাত্র সারসংগ্ৰহ করিয়া লইতে হইয়াছে। নহিলে তুমি যে কথাটি আমার কাছে বলিয়াছ ঠিক সেই কথাটি আমি আর-কাহারও কর্ণগোচর করাইতে পারিতাম না, লোকে ঢের বন শুনিত এবং ভুল শুনিত । স্রোতস্বিনী দক্ষিণ পার্শ্বে ঈষৎ মুখ ফিরাইয়া একটা বহি খুলিয়া তাহার পাতা উলটাইতে উলটাইতে কহিল- তুমি আমাকে স্নেহ কর বলিয়া আমাকে যতখানি দেখ আমি তো বাস্তবিক ততখানি নহি । আমি কহিলাম— আমার কি এত স্নেহ আছে যে, তুমি বাস্তবিক যতখানি আমি তোমাকে ততখানি দেখিতে পাইব ? একটি মানুষের সমস্ত কে ইয়ত্তা করিতে পারে ? ঈশ্বরের মতো কাহার স্নেহ ? ক্ষিতি তো একেবারে অস্থির হইয়া উঠিল, কহিল— এ! আবার তুমি কী কথা তুলিলে ! স্রোতস্বিনী তোমাকে এক ভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি আর-এক ভাবে তাহার উত্তর দিলে । আমি কহিলাম— জানি । কিন্তু কথাবার্তায় এমন অসংলগ্ন উত্তর-প্রত্যুত্তর হইয়া থাকে । মন এমন একপ্রকার দাহ্য পদার্থ যে, ঠিক যেখানে প্রশ্নস্ফুলিঙ্গ পড়িল সেখানে কিছু না হইয়া হয়তো দশ হাত দূরে আর-এক জায়গায় দপ করিয়া জুলিয়া উঠে । নির্বাচিত কমিটিতে বাহিরের লোকের প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু বৃহৎ উৎসবের স্থলে যে আসে তাহাকেই ডাকিয়া বসানো যায় । আমাদের কথোপকথন-সভা সেই উৎসব-সভা ; সেখানে যদি একটা অসংলগ্ন কথা অনাহূত আসিয়া উপস্থিত হয়, তবে তৎক্ষণাৎ তাহাকে ‘আসুন মশায়, বসুন’ বলিয়া আহবান করিয়া হাস্যমুখে তাহার পরিচয় না। লইলে উৎসবের উদারতা দূর হয় । − Y ক্ষিতি কহিল— ঘাট হইয়াছে ! তবে তাই করো, কী বলিতেছিলে বলে । ক উচ্চারণমাত্র কৃষ্ণকে স্মরণ করিয়া প্ৰহলাদ কাদিয়া উঠে, তাহার আর বর্ণমালা শেখা হয় না । একটা প্রশ্ন শুনিবা মাত্র যদি আর-একটা উত্তর তোমার মনে ওঠে। তবে তো কোনো কথাই এক পা অগ্রসর হয় না । কিন্তু । প্ৰহলাদজাতীয় লোককে নিজের খেয়াল অনুসারে চলিতে দেওয়াই ভালো, যাহা মনে আসে বলো । আমি কহিলাম— আমি বলিতেছিলাম, যাহাকে আমরা ভালোবাসি কেবল তাহারই মধ্যে আমরা অনন্তের পরিচয় পাই । এমন-কি, জীবের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করারই অন্য নাম ভালোবাসা । প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্যসম্ভোেগ । ইহা হইতে মনে পড়িল, সমস্ত বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে এই গভীর তত্ত্বটি নিহিত রহিয়াছে । ক্ষিতি মনে মনে ভাবিল— কী সর্বনাশ ! আবার তত্ত্বকথা কোথা হইতে আসিয়া পড়িল ! স্রোতস্বিনী এবং দীপ্তিও যে তত্ত্বকথা শুনিবার জন্য অতিশয় লালায়িত তাহা নহে— কিন্তু একটা কথা যখন মনের অন্ধকারের ভিতর হইতে হঠাৎ লাফাইয়া ওঠে তখন তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শেষ পর্যন্ত ধাবিত হওয়া ভাব-শিকারীর একটা চিরাভ্যস্ত কাজ । নিজের কথা নিজে আয়ত্ত করিবার জন্য বকিয়া যায়, লোকে মনে করে আমি অন্যকে তত্ত্বোপদেশ দিতে বসিয়াছি । আমি কহিলাম— বৈষ্ণবধর্ম পৃথিবীর সমস্ত প্ৰেম-সম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিতে চেষ্টা করিয়াছে। যখন দেখিয়াছে মা আপনার সন্তানের মধ্যে আনন্দের আর অবধি পায় না, সমস্ত হৃদয়খানি মুহুর্তে মুহুর্তে ভঁাজে ভজে খুলিয়া ঐ ক্ষুদ্র মানবন্ধুরটিকে সম্পূর্ণ বেষ্টন করিয়া শেষ করিতে পারে না, তখন আপনার সন্তানের মধ্যে আপনার ঈশ্বরকে উপাসনা করিয়াছে। যখন দেখিয়াছে প্রভুর জন্য দাস আপনার প্রাণ দেয়, বন্ধুর জন্য বন্ধু আপনার স্বাৰ্থ বিসর্জন করে, প্রিয়তম এবং প্ৰিয়তমা পরস্পরের নিকটে আপনার সমস্ত আত্মাকে সমর্পণ করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠে, তখন এই সমস্ত পরম