পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS O রবীন্দ্র-রচনাবলী আশ্রয় লইয়াছে, সংসারে কেবল একটিমাত্র অবশিষ্ট আছে। এখন দেখিতে পাই লোকালয়ে মানুষ ঢের আছে, কিন্তু ‘ভোলা মন, ও ভোলা মন, মানুষ কেন চিনলি না !” ভোলা মন, এই সংসারের মাঝখানে একবার প্রবেশ করিয়া দেখ, এই মানবহৃদয়ের ভিড়ের মধ্যে। সভাস্থলে যাহারা কথা কহিতে পারে না সেখানে তাহারা কথা কহিবে ; লোকসমাজে যাহারা এক প্ৰান্তে উপেক্ষিত হয়। সেখানে তাহাদের এক নূতন গৌরব প্রকাশিত হইবে ; পৃথিবীতে যাহাদিগকে অনাবশ্যক বোধ হয় সেখানে দেখিব তাঁহাদেরই সরল প্ৰেম, অবিশ্রাম সেবা, আত্মবিস্মৃত আত্মবিসর্জনের উপরে পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হইয়া রহিয়াছে। ভীষ্ম দ্ৰোণ ভীমাৰ্জন মহাকাব্যের নায়ক, কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুরুক্ষেত্রের মধ্যে ভূত্রে আমীয়-স্বজাতি আছে, সেই আধীয়তা কােন নবদ্বপায়ন আবিষ্কার করবে এবং প্রকাশ আমি কহিলাম— না করিলে কী এমন আসে যায় ! মানুষ পরস্পরকে না। যদি চিনিবে তবে পরস্পরকে এত ভালোবাসে কী করিয়া ? একটি যুবক তাহার জন্মস্থান ও আত্মীয়বর্গ হইতে বহু দূরে দু-দশ টাকা বেতনে ঠিক মুহুরিগিরি করিত । আমি তাহার প্রভু ছিলাম, কিন্তু প্ৰায় তাহার অস্তিত্বও অবগত ছিলাম না, সে এত সামান্য লোক ছিল । একদিন রাত্রে সহসা তাহার ওলাউঠা হইল । আমার শয়নগৃহ হইতে শুনিতে পাইলাম সে পিসিমা” “পিসিমা” করিয়া কাতরস্বরে কঁদিতেছে। তখন সহসা তাহার গৌরবহীন ক্ষুদ্র জীবনটি আমার নিকট কতখানি বৃহৎ হইয়া দেখা দিল । সেই- যে একটি অজ্ঞাত অখ্যাত মুখ নির্বোিধ লোক বসিয়া বসিয়া ঈষৎ গ্ৰীবা হেলাইয়া কলম খাড়া করিয়া ধরিয়া একমনে নকল করিয়া যাইত, তাহাকে তাহার পিসিমা আপন নিঃসন্তান বৈধব্যের সমস্ত সঞ্চিত মেহরাশি দিয়া মানুষ করিয়াছেন। সন্ধ্যাবেলায় শ্রান্তদেহে শূন্য বাসায় ফিরিয়া যখন সে স্বহস্তে উনান ধরাইয়া পাক চড়াইত, যতক্ষণ অন্ন টগবগা করিয়া না ফুটিয়া উঠিত, ততক্ষণ কম্পিত অগ্নিশিখার দিকে একদুষ্টে চাহিয়া সে কি সেই দূরকুটিরবাসিনী স্নেহশালিনী কল্যাণময়ী পিসিমার কথা ভাবিত না ? একদিন যে তাহার নিকলে ভুল হইল, ঠিকে মিল হইল না, তাহার উচ্চতন কর্মচারীর নিকট সে লাঞ্ছিত। হইল, সেদিন কি সকালের চিঠিতে তাহার পিসিমার পীড়ার সংবাদ পায় নাই ? এই নগণ্য লোকটার প্রতিদিনের মঙ্গলবার্তার জন্য একটি স্নেহপরিপূর্ণ পবিত্র হৃদয়ে কি সামান্য উৎকণ্ঠা ছিল ! এই দরিদ্র যুবকের প্রবাসবাসের সহিত কি কম করুণা কাতরতা উদবেগ জড়িত হইয়া ছিল ! সহসা সেই রাত্রে এই নির্বাণপ্ৰায় ক্ষুদ্র প্রাণশিখা এক অমূল্য মহিমায় আমার নিকটে দীপ্যমান হইয়া উঠিল । বুঝিতে পারিলাম। এই তুচ্ছ লোকটিকে যদি কোনোমতে বাচাইতে পারি। তবে এক বৃহৎ কাজ করা হয় । সমস্ত রাত্রি জাগিয়া তাহার সেবাশুশ্রুষা করিলাম, কিন্তু পিসিমার ধনকে পিসিমার নিকট ফিরাইয়া দিতে পারিলাম না— আমার সেই ঠিকা মুহুরির মৃত্যু হইল। ভীষ্ম দ্ৰোণ ভীমাৰ্জন খুব মহৎ, তথাপি এই লোকটিরও মূল্য অল্প নহে। তাহার মূল্য কোনো কবি অনুমান করে নাই, কোনো পাঠক স্বীকার করে নাই, তাই বলিয়া সে মূল্য পৃথিবীতে অনাবিষ্কৃত ছিল না— একটি জীবন আপনাকে তাহার জন্য একান্ত উৎসগা করিয়াছিল- কিন্তু খোরাক-পোশাক সমেত লোকটার বেতন ছিল আট টাকা, তাহাও বারো মাস নহে। মহত্ত্ব আপনার জ্যোতিতে আপনি প্রকাশিত হইয়া উঠে, আর আমাদের মতো দীপ্তিহীন ছোটো ছোটো লোকদিগকে বাহিরের প্রেমের আলোকে প্রকাশ করিতে হয় ; পিসিমার ভালোবাসা দিয়া দেখিলে আমরা সহসা দীপ্যমান হইয়া উঠি । যেখানে অন্ধকারে কাহাকেও দেখা যাইতেছিল না, সেখানে প্রেমের আলোক ফেলিলে সহসা দেখা যায়— মানুষে পরিপূর্ণ। ’ স্রোতস্বিনী দয়াস্নিগ্ধ মুখে কহিল— তোমার ঐ বিদেশী মুহুরির কথা তোমার কাছে পূর্বে শুনিয়াছি। জানি না, উহার কথা শুনিয়া কেন আমাদের হিন্দুস্থানি বেহারা নিহরকে মনে পড়ে । সম্প্রতি দুটি শিশুসন্তান রাখিয়া তাহার স্ত্রী মরিয়া গিয়াছে। এখন সে কাজকর্ম করে, দুপুরবেলা বসিয়া পাখা টানে, কিন্তু এমন শুষ্ক শীর্ণ ভগ্ন লক্ষ্মীছাড়ার মতো হইয়া গেছে ! তাহাকে যখনই দেখি কষ্ট হয়, কিন্তু সে কষ্ট যেন ইহার একলার জন্য নহে- আমি ঠিক বুঝাইতে পারি না, কিন্তু মনে হয় যেন সমস্ত মানবের জন্য একটা বেদনা অনুভূত হইতে থাকে ।