পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত ܠ ܓ ܬ স্রোতস্বিনী অবহিত ছাত্রীর মতো সমীরের সমস্ত কথা শুনিলেন। তাহার সুন্দর নম্র মুখের উপর একটা যেন নূতন আলোক আসিয়া পড়িল । অন্য দিন নিজের একটা মত বলিতে যেরূপ ইতস্তত করিতেন, আজ সেরূপ না করিয়া একেবারে আরম্ভ করিলেন- সমীরের কথায় আমার মনে একটি। ভাবের উদয় হইয়াছে, আমি ঠিক পরিষ্কার করিয়া বলিতে পারিব কি না জানি না । সৃষ্টির যে অংশের সহিত আমাদের হৃদয়ের যোগ— অর্থাৎ, সৃষ্টির যে অংশ শুদ্ধমাত্র আমাদের মনে জ্ঞান সঞ্চার করে না, হৃদয়ে ভােব সঞ্চার করে- যেমন ফুলের সৌন্দর্য, পর্বতের মহত্ত্ব— সেই অংশে কতই নৈপুণ্য খেলাইতে হইয়াছে, কতই রঙ ফলাইতে কত আয়োজন করিতে হইয়াছে ! ফুলের প্রত্যেক পাপড়িটিকে কত যত্নে সূগোল সুডোল করিতে হইয়াছে, তাহাকে বৃন্তের উপর কেমন সুন্দর বঙ্কিম ভঙ্গিতে দাড় করাইতে হইয়াছে, পর্ব চর মাথায় চিরতুষারমুকুট পরাইয়া তাহাকে নীলাকাশের মধ্যে কেমন মহিমার সহিত আসীন করা হইয়াছে, পশ্চিমসমুদ্রতীরের সূর্যস্তপটের উপর কত রঙের কত তুলি পড়িয়াছে। ভূতল হইতে নভস্তল পর্যন্ত কত সাজসজ্জা, কত রঙচঙ, কত ভাবভঙ্গি, তবে আমাদের এই ক্ষুদ্র মানুষের মন ভুলিয়াছে ! ঈশ্বর তাহার রচনায় যেখানে প্ৰেম সৌন্দর্য মহত্ত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, সেখানে তাহাকেও গুণাপনা করিতে হইয়াছে । সেখানে তাহাকেও ধ্বনি এবং ছন্দ, বৰ্ণ । এবং গন্ধ বহু যত্নে বিন্যাস করিতে হইয়াছে। অরণ্যের মধ্যে যে ফুল ফুটাইয়াছেন তাহাতে কত পাপড়ির অনুপ্রাস ব্যবহার করিয়াছেন এবং আকাশপটে একটিমাত্র জ্যোতিঃপাত করিতে তাহাকে যে কেমন সুনির্দিষ্ট সুসংযত ছন্দ রচনা করিতে হইয়াছে বিজ্ঞান তাহার পদ ও অক্ষর গণনা করিতেছে। ভাব প্রকাশ করিতে মানুষকেও নানা নৈপুণ্য অবলম্বন করিতে হয়, শব্দের মধ্যে সংগীত আনিতে হয়, ছন্দ আনিতে হয়, সৌন্দর্য আনিতে হয়, তবে মনের কথা মনের মধ্যে গিয়া প্ৰবেশ করে । ইহাকে যদি এই বলিয়া স্রোতস্বিনী আমার মুখের দিকে চাহিয়া যেন সাহায্য প্রার্থনা করিল— তাহার চােখের ভাবটা এই, আমি কী কতকগুলা বকিয়া গেলাম তাহার ঠিক নাই, তুমি ঐটেকে আর-একটু পরিষ্কার করিয়া বলো-না । এমন সময় ব্যোম হঠাৎ বলিয়া উঠিল— সমস্ত বিশ্বরচনা যে কৃত্রিম এমন মতও আছে । স্রোতস্বিনী যেটাকে ভাবের প্রকাশ বলিয়া বৰ্ণনা করিতেছেন, অর্থাৎ দৃশ্য শব্দ গন্ধ ইত্যাদি, সেটা যে মায়ামাত্র, অর্থাৎ আমাদের মনের কৃত্রিম রচনা এ কথা অপ্রমাণ করা বড়ো কঠিন । ক্ষিতি মহা বিরক্ত হইয়া উঠিয়া কহিলেন- তোমরা সকলে মিলিয়া ধান ভানিতে শিবের গান তুলিয়াছ। কথাটা ছিল এই, ভাব প্রকাশের জন্য পদ্যের কোনো আবশ্যক আছে কি না । তোমরা তাহা । হইতে একেবারে সমুদ্র পার হইয়া সৃষ্টিতত্ত্ব লয়তত্ত্ব মায়াবাদ প্রভৃতি চােরাবালির মধ্যে গিয়া উত্তীৰ্ণ । হইয়াছ । আমার বিশ্বাস, ভাবপ্রকাশের জন্য ছন্দের সৃষ্টি হয় নাই । ছোটাে ছেলেরা যেমন ছড়া অবস্থায় অর্থহীন কথার ঝংকারমাত্ৰই কানে ভালো লাগিত । এইজন্য অর্থহীন ছড়াই মানুষের সর্বপ্রথম কবিত্ব । মানুষের এবং জাতির বয়স ক্রমে যতই বাড়িতে থাকে, ততই ছন্দের সঙ্গে অর্থের সংযোগ না করিলে তাহার সম্পূর্ণ তৃপ্তি হয় না। কিন্তু বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও অনেক সময়ে মানুষের মধ্যে দুই-একটা । গোপন ছায়াময় স্থানে বালক-অংশ থাকিয়া যায় ; ধ্বনিপ্রিয়তা, ছন্দঃপ্রিয়তা সেই গুপ্ত বালকের । স্বভাব। আমাদের বয়ঃপ্রাপ্ত অংশ অর্থ চাহে, ভাব চাহে ; আমাদের অপরিণত অংশ ধ্বনি চাহে, ছন্দ চাহে । দীপ্তি গ্ৰীবা বক্র করিয়া কহিলেন- ভাগ্যে আমাদের সমস্ত অংশ বয়ঃপ্ৰাপ্ত হইয়া উঠে না । মানুষের নাবালক-অংশটিকে আমি অন্তরের সহিত ধন্যবাদ দিই, তাহারই কল্যাণে জগতে যা কিছু शिछेए उाछ । সমীর কহিলেন- যে ব্যক্তি একেবারে পুরোপুরি পাকিয়া গিয়াছে সেই জগতের জ্যাঠা ছেলে । কোনো রকমের খেলা, কোনো রকমের ছেলেমানুষ তাহার পছন্দসই নহে। আমাদের আধুনিক হিন্দুজাতটা পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে জ্যাঠা জাত, অত্যন্ত বেশি মাত্রায় পাকামি করিয়া থাকে, অথচ