পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ò R SR রবীন্দ্র-রচনাবলী নানান বিষয়ে কাচা । জ্যাঠা ছেলের এবং জ্যাঠা জাতির উন্নতি হওয়া বড়ো দুরূহ ; কারণ, তাহার মনের মধ্যে নম্রতা নাই । আমার এ কথাটা প্ৰাইভেট । কোথাও যেন প্ৰকাশ না হয় । আজকাল লোকের মেজাজ ভালো নয় । আমি কহিলাম— যখন কলের জাতা চালাইয়া শহরের রাস্তা মেরামত হয়, তখন কাষ্ঠফলকে লেখা থাকে— কল চলিতেছে! সাবধান ! আমি ক্ষিতিকে পূর্বে হইতে সাবধান করিয়া দিতেছি, আমি কল চালাইব । বাষ্পযানকে তিনি সর্বাপেক্ষা ভয় করেন, কিন্তু সেই কল্পনাবাষ্প-যোগে গতিবিধিই আমার সহজসাধ্য বোধ হয় । গদ্যপদ্যের প্রসঙ্গে আমি আর-একবার শিবের গান গাহিব ৷ ইচ্ছা হয় শোনো । গতির মধ্যে খুব একটা পরিমাণ-করা নিয়ম আছে। পেড়ুলম নিয়মিত তালে দুলিয়া থাকে । চলিবার সময় মানুষের পা মাত্রা রক্ষা করিয়া উঠে পড়ে এবং সেইসঙ্গে তাহার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সমান তাল ফেলিয়া গতির সামঞ্জস্য বিধান করিতে থাকে । সমুদ্রতরঙ্গের মধ্যে একটা প্ৰকাণ্ড লয় আছে। এবং পৃথিবী এক মহাছন্দে সূর্যকে প্ৰদক্ষিণ করে— ব্যোমচন্দ্ৰ অকস্মাৎ আমাকে কথার মাঝখানে থামাইয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন- স্থিতিই যথার্থ স্বাধীন, সে আপনার অটল গাম্ভীর্যে বিরাজ করে, কিন্তু গতিকে প্রতিপদে আপনাকে নিয়মে বাধিয়া চলিতে হয় । অথচ সাধারণের মধ্যে একটা ভ্ৰান্ত সংস্কার আছে যে, গতিই স্বাধীনতার যথার্থ স্বরূপ এবং স্থিতিই বন্ধন । তাহার কারণ, ইচ্ছাই মনের একমাত্র গতি এবং ইচ্ছা-অনুসারে চলাকেই মূঢ় লোকে স্বাধীনতা বলে । কিন্তু আমাদের পণ্ডিতেরা জানিতেন, ইচ্ছাই আমাদের সকল গতির কারণ, সকল বন্ধনের মূল ; এইজন্য মুক্তি অর্থাৎ চরম স্থিতি লাভ করিতে হইলে ঐ ইচ্ছাটাকে গোড়া ঘেষিয়া কাটিয়া ফেলিতে তাহারা বিধান দেন, দেহমানের সর্বপ্রকার গতিরোধ করাই যোগসাধন । সমীর ব্যোমের পৃষ্ঠে হাত দিয়া সহাস্যে কহিলেন— একটা মানুষ যখন একটা প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছে, তখন মাঝখানে তাহাব গতিরোধ করার নাম গোলযোগ-সাধন । আমি কহিলাম- বৈজ্ঞানিক ক্ষিতির নিকট অবিদিত নাই যে, গতির সহিত গতির, এক কম্পনের সহিত অন্য কম্পনের ভারি একটা কুটুম্বিতা আছে। সা সুরের তার বাজিয়া উঠিলে মা সুরের তার কঁপিয়া উঠে । আলোকতরঙ্গ, উত্তাপতরঙ্গ, ধ্বনিতরঙ্গ, স্নায়ুতরঙ্গ প্রভৃতি সকলপ্রকার তরঙ্গের মধ্যে এইরূপ একটা আত্মীয়তার বন্ধন আছে । আমাদের চেতনাও একটা তরঙ্গিত কম্পিত অবস্থা । এইজন্য বিশ্বসংসারের বিচিত্ৰ কম্পনের সহিত তাহার যোগ আছে। ধ্বনি আসিয়া তাহার স্নায়ুদোলায় দোল দিয়া যায়, আলোকরশ্মি আসিয়া তাহার স্নায়ুতন্ত্রীতে অলৌকিক অঙ্গুলি আঘাত করে। তাহার চিরকম্পিত স্নায়ুজাল তাহাকে জগতের সমুদয় স্পন্দনের ছন্দে নানাসূত্রে বঁাধিয়া জাগ্ৰত করিয়া রাখিয়াছে । হৃদয়ের বৃত্তি, ইংরাজিতে যাহাকে ইমোশন বলে, তাহা আমাদের হৃদয়ের আবেগ, অর্থাৎ গতি ; তাহার সহিতও অন্যান্য বিশ্বকম্পনের একটা মহা ঐক্য আছে । আলোকের সহিত, বর্ণের সহিত, ধ্বনির সহিত তাহার একটা স্পন্দনের যোগ, একটা সুরের মিল আছে। এইজন্য সংগীত এমন অব্যবহিতভাবে আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করিতে পারে, উভয়ের মধ্যে মিলন হইতে অধিক বিলম্ব হয় না। ঝড়ে এবং সমুদ্রে যেমন মাতামতি হয়, গানে এবং প্ৰাণে তেমনি একটি নিবিড় সংঘর্ষ হইতে থাকে । কারণ, সংগীত আপনার কম্পন সঞ্চার করিয়া আমাদের সমস্ত অন্তরকে চঞ্চল করিয়া তোলে । একটা অনিৰ্দেশ্য আবেগে আমাদের প্রাণকে পূর্ণ করিয়া দেয়। মন উদাস হইয়া যায়। অনেক কবি এই অপরাপ ভাবকে অনন্তের জন্য আকাঙক্ষা বলিয়া নাম দিয়া থাকেন । আমিও কখনো কখনো এমনতরো ভাব অনুভব করিয়াছি এবং এমনতরো ভাষাও প্রয়োগ করিয়া থাকিব । কেবল সংগীত কেন, সন্ধ্যাকাশের সূর্যস্তচ্ছটািও কতবার আমার অন্তরের মধ্যে অনন্ত বিশ্বজগতের হৃৎস্পন্দন সঞ্চারিত করিয়া দিয়াছে ; যে-একটি অনির্বচনীয় বৃহৎ সংগীত ধ্বনিত করিয়াছে তাহার সহিত আমার প্রতিদিনের সুখদুঃখের কোনো যোগ নাই, তাহা বিশ্বেশ্বরের মন্দির প্রদক্ষিণ করিতে করিতে নিখিল