পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 RN) রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ব্যোম কহিল- এ-সকল কথায় মতের মিল করিবার চেষ্টা করিয়ো না । এ-সকল গোড়াকার কথা লইয়া আমি কোনো মতের সহিতই বিবাদ করি না । জীবনযাত্রার ব্যবসায়ে প্রত্যেক জাতিই নিজরাজ্য-প্রচলিত মুদ্রা লইয়া মূলধন সংগ্রহ করে-- কথাটা এই, দেখিতে হইবে ব্যাবসা চলে কি না । জীব সুখদুঃখ বিপদ-সম্পদের মধ্যে শিক্ষালাভ করিবার জন্য সংসারশিক্ষাশালায় প্রেরিত হইয়াছে এই মতটিকে মূলধন করিয়া লইয়া জীবনযাত্রা সুচারুরূপে চলে, অতএব আমার মতে এ মুদ্রাটি মেকি নহে । আবার যখন প্ৰসঙ্গক্রমে অবসর উপস্থিত হইবে তখন দেখাইয়া দিব যে, আমি যে ব্যাঙ্ক-নোটটি লইয়া জীবনবাণিজ্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি বিশ্ববিধাতার ব্যাঙ্কে সে নোটও গ্রাহ্য হইয়া থাকে । ক্ষিতি করুণস্বরে কহিল— দোহাই ভাই, তোমার মুখে প্রেমের কথাই যথেষ্ট কঠিন বোধ হয়, অতঃপর বাণিজ্যের কথা যদি অবতারণ করা। তবে আমাকেও এখান হইতে অবতারণা করিতে হইবে ; আমি অত্যন্ত দুর্বল বোধ করিতেছি। যদি অবসর পাই তবে আমিও একটা তাৎপর্য শুনাইতে পারি। ব্যোম চৌকিতে ঠেসান দিয়া বসিয়া জানলার উপর দুই পা তুলিয়া দিল। ক্ষিতি কহিল— আমি দেখিতেছি এভোল্যুশন থিয়োরি অর্থাৎ অভিব্যক্তিবাদের মোট কথাটা এই কবিতার মধ্যে রহিয়া গিয়াছে। সঞ্জীবনী বিদ্যাটার অর্থ, বাচিয়া থাকিবার বিদ্যা । সংসারে স্পষ্টই দেখা যাইতেছে একটা লোক সেই বিদ্যাটা অহরহ। অভ্যাস করিতেছে— সহস্ৰ বৎসর কেন, লক্ষসহস্ৰ বৎসর ধরিয়া । কিন্তু যাহাকে অবলম্বন করিয়া সে সেই বিদ্যা অভ্যাস করিতেছে সেই প্ৰাণী বংশের প্রতি তাহার কেবল ক্ষণিক প্ৰেম দেখা যায়। যেই একটা পরিচ্ছেদ সমাপ্ত হইয়া যায় আমনি নিষ্ঠুর প্রেমিক চঞ্চল অতিথি তাহাকে অকাতরে ধ্বংসের মুখে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যায় । পৃথিবীর স্তরে স্তরে এই নির্দয় বিদায়ের বিলাপগান প্রস্তরপটে অঙ্কিত রহিয়াছে - দীপ্তি ক্ষিতির কথা শেষ না হইতে হইতেই বিরক্ত হইয়া কহিল— তোমরা এমন করিয়া যদি তাৎপর্য বাহির করিতে থাক তাহা হইলে তাৎপর্যের সীমা থাকে না । কাষ্ঠকে দগ্ধ করিয়া দিয়া অগ্নির বিদায়গ্ৰহণ, গুটি কাটিয়া ফেলিয়া প্ৰজাপতির পলায়ন, ফুলকে বিশীর্ণ করিয়া ফলের বহিরাগমন, বীজকে বিদীর্ণ করিয়া অন্ধুরের উদগম, এমন রাশি রাশি তাৎপর্য স্তুপাকার করা যাইতে পারে । ব্যোম গম্ভীরভাবে কহিতে লাগিল— ঠিক বটে। ওগুলা তাৎপর্য নহে, দৃষ্টান্ত মাত্র । উহাদের ভিতরকার আসল কথাটা এই সংসারে আমরা অন্তত দুই পা ব্যবহার না করিয়া চলিতে পারি না । বাম পদ যখন পশ্চাতে আবদ্ধ থাকে দক্ষিণ পদ সম্মুখে অগ্রসর হইয়া যায়, আবার দক্ষিণ পদ সম্মুখে আবদ্ধ হইলে পর বাম পদ আপন বন্ধন ছেদন করিয়া অগ্ৰে ধাবিত হয় । আমরা একবার করিয়া আপনাকে বাধি, আবার পরীক্ষণেই সেই বন্ধন ছেদন করি । আমাদিগকে ভালোবাসিতেও হইবে এবং সে ভালোবাসা কাটিতেও হইবে— সংসারের এই মহত্তম দুঃখ, এবং এই মহৎ দুঃখের মধ্য দিয়াই আমাদিগকে অগ্রসর হইতে হয় । সমাজ সম্বন্ধেও এ কথা খাটে । নূতন নিয়ম যখন কালক্রমে প্রাচীন প্রথারূপে আমাদিগকে একস্থানে আবদ্ধ করে তখন সমাজবিপ্লব আসিয়া তাহাকে উৎপাটন-পূর্বক আমাদিগকে মুক্তিদান করে । যে পা ফেলি। সে পা পরীক্ষণে তুলিয়া লইতে হয় নতুবা চলা হয় না, অতএব অগ্রসর হওয়ার মধ্যে পদে পদে বিচ্ছেদবেদনা, ইহা বিধাতার বিধান । সমীর কহিল- গল্পটার সর্বশেষে যে-একটি অভিশাপ আছে তোমরা কেহ সেটার উল্লেখ কর নাই । কচ যখন বিদ্যালাভ করিয়া দেবযানীর প্ৰেমবন্ধন বিচ্ছিন্ন করিয়া যাত্রা করেন তখন দেবযানী তঁহাকে অভিশাপ দিলেন যে, তুমি যে বিদ্যা শিক্ষা করিলে সে বিদ্যা অন্যকে শিক্ষা দিতে পরিবে, কিন্তু নিজে ব্যবহার করিতে পরিবে না ; আমি সেই অভিশাপ-সমেত একটা তাৎপর্য বাহির করিয়াছি, যদি ধৈর্য থাকে তো বলি । ক্ষিতি কহিল— ধৈর্য থাকিবে কি না পূর্বে হইতে বলিতে পারি না। প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিয়া শেষে প্ৰতিজ্ঞা রক্ষা না হইতেও পারে । তুমি তো আরম্ভ করিয়া দাও, শেষে যদি অবস্থা বুঝিয়া তোমার দয়ার সঞ্চার হয় থামিয়া গেলেই হইবে । সমীর কহিল— ভালো করিয়া জীবন ধারণ করিবার বিদ্যাকে সঞ্জীবনী বিদ্যা বলা যাক । মনে করা