পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Id Rbr রবীন্দ্র-রচনাবলী করিতে থাকেন । এ যেন আতশবাজিতে আগুন ধরাইয়া দেওয়া- কাব্য সেই অগ্নিশিখা, পাঠকদের মন ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের আতশবাজি । আগুন ধরিবা মাত্র কেহ বা হাউইয়ের মতো একেবারে আকাশে উড়িয়া যায়, কেহ বা তুবড়ির মতো উচ্ছসিত হইয়া উঠে, কেহ বা বোমার মতো আওয়াজ করিতে থাকে । তথাপি মোটের উপর শ্ৰীমতী স্রোতস্বিনীর সহিত আমার মতবিরোধ দেখিতেছি না । অনেকে বলেন, আঁঠিই ফলের প্রধান অংশ, এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা তাহার প্রমাণ করাও যায়। কিন্তু তথাপি অনেক রসজ্ঞ ব্যক্তি ফলের শস্যটি খাইয়া তাহার আঁঠি ফেলিয়া দেন। তেমনি কোনাে কাব্যের মধ্যে যদি বা কোনাে বিশেষ শিক্ষা থাকে তথাপি কাব্যরসজ্ঞ ব্যক্তি তাহার রসপূর্ণ কাব্যাংশটুকু লইয়া শিক্ষাংশটুকু ফেলিয়া দিলে কেহ তঁহাকে দোষ দিতে পারে না। কিন্তু র্যাহারা আগ্রহসহকারে কেবল ঐ শিক্ষাংশটুকুই বাহির করিতে চাহেন আশীর্বাদ করি তাহারাও সফল হউন এবং সুখে থাকুন। আনন্দ কাহাকেও বলপূর্বক দেওয়া যায় না। কুসুম্ভফুল হইতে কেহ বা তাহার রঙ বাহির করে, কেহ বা তৈলের জন্য তাহার বীজ বাহির করে, কেহ বা মুগ্ধনেত্ৰে তাহার শোভা দেখে । কাব্য হইতে কেহ বা ইতিহাস আকর্ষণ করেন, কেহ বা দর্শন উৎপাটন করেন, কেহ বা নীতি কেহ বা বিষয়ঞ্জান উদঘাটন করিয়া থাকেন, আবার কেহ বা কাব্য হইতে কাব্য ছাড়া আর কিছুই বাহির করিতে পারেন না।— যিনি যাহা পাইলেন তাহাই লইয়া সন্তুষ্টচিত্তে ঘরে ফিরিতে পারেন, কাহারও সহিত বিরোধের আবশ্যক দেখি না- বিরোধে ফলও নাই । NG2še SSoo S i প্ৰাঞ্জলতা স্রোতস্বিনী কোনো-এক বিখ্যাত ইংরাজ কবির উল্লেখ করিয়া বলিলেন- কে জানে, তাহার রচনা আমার কাছে ভালো লাগে না । দীপ্তি আরো প্রবলতরভাবে স্রোতস্বিনীর মত সমর্থন করিলেন । সমীর কখনো পারতপক্ষে মেয়েদের কোনো কথার স্পষ্ট প্রতিবাদ করে না। তাই সে একটু হাসিয়া ইতস্তত করিয়া কহিল- কিন্তু অনেক বড়ো বড়ো সমালোচক তাহাকে খুব উচ্চ আসন দিয়া থাকেন । দীপ্তি কহিলেন— আগুন যে পোড়ায় তাহা ভালো করিয়া বুঝিবার জন্য কোনো সমালোচকের সাহায্য আবশ্যক করে না, তাহা নিজের বাম হস্তের কড়ে আঙুলের ডগার দ্বারাও বোঝা যায় ; ভালো কবিতারবুলু যদি তেমনি অবহেলেনা বুঝতে পারি তবে আমি তাহার সমালােচনা পড়া আবশ্যক বোধ করি না । আগুনের যে পোড়াইবার ক্ষমতা আছে সমীর তাহা জানিত, এইজন্য সে চুপ করিয়া রহিল ; কিন্তু ব্যোম বেচারার সে-সকল বিষয়ে কোনোরূপ কাণ্ডজ্ঞান ছিল না, এইজন্য সে উচ্চস্বরে আপনি স্বাগত-উক্তি আরম্ভ করিয়া দিল । সে বলিল— মানুষের মন মানুষকে ছাড়াইয়া চলে, অনেক সময় তাহাকে নাগাল পাওয়া যায় নাক্ষিতি তাহাকে বাধা দিয়া কহিল— ত্রেতাযুগে হনুমানের শতযোজন লাঙ্গুল শ্ৰীমান হনুমানজিউকে ছাড়াইয়া বহু দূরে গিয়া পৌঁছিত ; লাঙ্গুলের ডগাটুকুতে যদি উকুন বসিত তবে তাহা চুলকাইয়া আসিবার জন্য ঘোড়ার ডাক বসাইতে হইত। মানুষের মন হনুমানের লাঙ্গুলের অপেক্ষাও সুদীর্ঘ, সেইজন্য এক-এক সময়ে মন যেখানে গিয়া পৌঁছায়, সমালোচকের ঘোড়ার ডাক ব্যতীত সেখানে হাত পৌঁছে না । লেজের সঙ্গে মনের প্রভেদ এই যে, মনটা আগে আগে চলে এবং লেজটা পশ্চাতে পড়িয়া থাকে । এইজন্যই জগতে লেজের এত লাঞ্ছনা এবং মনের এত মাহাত্ম্য । ক্ষিতির কথা শেষ হইলে ব্যোম পুনশ্চ আরম্ভ করিল- বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য জানা, এবং দর্শনের উদ্দেশ্য বোঝা, কিন্তু কাণ্ডটি এমনি হইয়া দাড়াইয়াছে যে, বিজ্ঞানটি জানা এবং দর্শনটি বোঝাই অন্য সকল জানা এবং অন্য সকল বোঝার অপেক্ষা শক্ত হইয়া উঠিয়াছে। ইহার জন্য কত ইস্কুল, কত কেতাব, কত আয়োজন আবশ্যক হইয়াছে। সাহিত্যের উদ্দেশ্য আনন্দ দান করা, কিন্তু সে আনন্দটি