পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভুত ᎣᏔᎼᏔᏬ ধারণায় আঘাত করে। সেই আঘাত ঈষৎ পীড়াজনক ; কিন্তু সেই পীড়ার পরিমাণ এমন নিয়মিত যে, তাহাতে আমাদিগকে যে পরিমাণে দুঃখ দেয়, আমাদের চেতনাকে অকস্মাৎ চঞ্চল করিয়া তুলিয়া তদপেক্ষা অধিক সুখী করে । এই সীমা ঈষৎ অতিক্রম করিলেই কৌতুক প্রকৃত পীড়ায় পরিণত হইয়া উঠে। যদি যথার্থ ভক্তির কীর্তনের মাঝখানে কোনাে রসিকতাবায়ুগ্ৰস্ত ছােকরা হঠাৎ শ্ৰীকৃষ্ণের ঐ তাম্রকুটধুমপিপাসুতার গান গাহিত। তবে তাহাতে কৌতুক বোধ হইত না ; কারণ আঘাতটা এত গুরুতর হইত যে, তৎক্ষণাৎ তাহা উদ্যত মুষ্টি -আকার ধারণ করিয়া উক্ত রসিক ব্যক্তির পৃষ্ঠাভিমুখে প্রবল প্ৰতিঘাতস্বরূপে ধাবিত হইত। অতএব, আমার মতে কৌতুক- চেতনাকে পীড়ন, আমোদও তাই । এইজন্য প্রকৃত আনন্দের প্রকাশ স্মিতহাস্য এবং আমোদ ও কৌতুকের প্রকাশ উচ্চহাস্য ; সে হাস্য যেন হঠাৎ একটা দ্রুত আঘাতের পীড়নবেগে সশব্দে উর্ধের্ব উদগীর্ণ হইয়া উঠে। ক্ষিতি কহিল— তোমরা যখন একটা মনের মতো থিয়োরির সঙ্গে একটা মনের মতো উপমা জুড়িয়া দিতে পাের, তখন আনন্দে আর সত্যাসত্য জ্ঞান থাকে না । ইহা সকলেরই জানা আছে কৌতুকে যে কেবল আমরা উচ্চহাস্য হাসি তাহা নহে, মৃদুহাস্যও হাসি, এমন-কি, মনে মনেও হাসিয়া থাকি । কিন্তু ওটা একটা অবান্তর কথা । আসল কথা এই যে, কৌতুক আমাদের চিত্তের উত্তেজনার কারণ, এবং চিত্তের অনতিপ্ৰবল উত্তেজনা আমাদের পক্ষে সুখজনক । আমাদের অন্তরে বাহিরে একটি সুযুক্তিসংগত নিয়মশৃঙ্খলার আধিপত্য ; সমস্তই চিরাভ্যস্ত চিরপ্রত্যাশিত ; এই সুনিয়মিত যুক্তিরাজ্যের সমভূমিমধ্যে যখন আমাদের চিত্ত অবাধে প্রবাহিত হইতে থাকে তখন তাহাকে বিশেষরূপে অনুভব করিতে পারি না— ইতিমধ্যে হঠাৎ সেই চারি দিকের যথাযোগ্যতা ও যথা পরিমিততার মধ্যে যদি একটা অসংগত ব্যাপারের অবতারণা হয় তবে আমাদের চিত্তপ্রবাহ অকস্মাৎ বাধা পাইয়া দুনিবার হাস্য তরঙ্গে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠে । সেই বাধা সুখের নহে, সৌন্দর্যের নহে, সুবিধার নহে, তেমনি আবার অতিন্দুঃখেরও নহে, সেইজন্য কৌতুকের সেই বিশুদ্ধ অমিশ্র উত্তেজনায় আমাদের আমোদ বোধ হয় । আমি কহিলাম— অনুভবক্রিয়ামাত্রই সুখের, যদি না তাহার সহিত কোনো গুরুতর দুঃখভয় ও স্বার্থহানি মিশ্রিত থাকে। এমন-কি, ভয় পাইতেও সুখ আছে, যদি তাহার সহিত বাস্তবিক ভয়ের কোনো কারণ জড়িত না থাকে । ছেলেরা ভূতের গল্প শুনিতে একটা বিষম আকর্ষণ অনুভব করে, কারণ, হৃৎকম্পের উত্তেজনায় আমাদের যে চিত্তচাঞ্চল্য জন্মে তাহাতেও আনন্দ আছে । রামায়ণে সীতাবিয়োগে রামের দুঃখে আমরা দুঃখিত হই, ওথেলোর অমূলক অসূয়া আমাদিগকে পীড়িত করে, দুহিতার কৃতঘ্নতাশরবিদ্ধ উন্মাদ লিয়রের মর্মযাতনায় আমরা ব্যথা বোধ করি— কিন্তু সেই দুঃখপীড়া বেদনা উদ্রেক করিতে না পারিলে সে-সকল কাব্য আমাদের নিকট তুচ্ছ হইত। বরঞ্চ দুঃখের কাব্যকে আমরা সুখের কাব্য অপেক্ষা অধিক সমাদর করি ; কারণ, দুঃখানুভবে আমাদের চিত্তে অধিকতর আন্দোলন উপস্থিত করে । কৌতুক মনের মধ্যে হঠাৎ আঘাত করিয়া আমদের সাধারণ অনুভবক্রিয়া জাগ্ৰত করিয়া দেয় । এইজন্য অনেক রসিক লোক হঠাৎ শরীরে একটা আঘাত করাকে পরিহাস জ্ঞান করেন ; অনেকে গালিকে ঠাট্টার স্বরূপে ব্যবহার করিয়া থাকেন ; বাসরঘরে কর্ণমর্দন এবং অন্যান্য পীড়ননৈপুণ্যকে বঙ্গসীমন্তিনীগণ এক শ্রেণীর হাস্যরস বলিয়া স্থির করিয়াছেন ; হঠাৎ উৎকট বোমার আওয়াজ করা আমাদের দেশে উৎসবের অঙ্গ এবং কর্ণবধিরকর খোল-করতালের শব্দ -দ্বারা চিত্তকে ধূমপীড়িত মৌচাকের মৌমাছির মতো একান্ত উদভ্ৰান্ত করিয়া ভক্তিরসের অবতারণা করা হয়। ক্ষিতি কহিল— বন্ধুগণ, ক্ষান্ত হও । কথাটা একপ্রকার শেষ হইয়াছে। যতটুকু পীড়নে সুখ বোধ হয় তাহা তোমরা অতিক্রম করিয়াছ, এক্ষণে দুঃখ ক্ৰমে প্রবল হইয়া উঠিতেছে। আমরা বেশ বুঝিয়াছি যে, কমেডির হাস্য এবং ট্র্যাজেডির অশ্রািজল দুঃখের তারতম্যের উপর নির্ভর করে ব্যোম কহিল— যেমন বরফের উপর প্রথম রৌদ্র পড়িলে তাহা ঝিকমিক করিতে থাকে এবং রৌদ্রের তাপ বাড়িয়া উঠিলে তাহা গলিয়া পড়ে । তুমি কতকগুলি প্রহসন ও ট্র্যাজেডির নাম করো, আমি তাহা হইতে প্ৰমাণ করিয়া দিতেছি এমন সময় দীপ্তি ও স্রোতস্বিনী হাসিতে হাসিতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ।