পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SVV রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তাহাতে দর্শকবৃন্দের সুখানুভব করিবার কোনো যুক্তিসংগত কারণ দেখা যায় না । এমন একটা উল্লাল্লুক, কৌতুকমাত্রেরই মধ্যে এমন একটা পদাৰ্থ আছে যাহাতে মানুষের সুখ না হইয়া দুখ হওয়া আমরা কথায় কথায় সেদিন ইহার একটা কারণ নির্দেশ করিয়াছিলাম। আমরা বলিয়াছিলাম, কৌতুকের হাসি এবং আমোদের হাসি একজাতীয়, উভয় হাস্যের মধ্যেই একটা প্রবলতা আছে। তাই আমাদের সন্দেহ হইয়াছিল যে, হয়তো আমোদ এবং কৌতুকের মধ্যে একটা প্রকৃতিগত সাদৃশ্য আছে ; সেইটে বাহির করিতে পারিলেই কৌতুকহাস্যের রহস্যভেদ হইতে পারে। সাধারণ ভাবের সুখের সহিত আমোদের একটা প্ৰভেদ আছে। নিয়মভঙ্গে যে একটু পীড়া আছে সেই পীড়াটুকু না থাকিলে আমোদ হইতে পারে না । আমোদ জিনিসটা নিত্যনৈমিত্তিক সহজ নিয়মসংগত নহে ; তাহা মাঝে মাঝে এক-এক দিনের ; তাহাতে প্ৰয়াসের আবশ্যক । সেই পীড়ন এবং প্ৰয়াসের সংঘর্ষে মনের যে-একটা উত্তেজনা হয় সেই উত্তেজনাই আমাদের প্রধান উপকরণ । আমরা বলিয়াছিলাম, কৌতুকের মধ্যেও নিয়মভঙ্গজনিত একটা পীড়া আছে ; সেই পীড়াটা অতি অধিক মাত্রায় না গেলে আমাদের মনে যে একটা সুখকর উত্তেজনার উদ্রেক করে, সেই আকস্মিক উত্তেজনার আঘাতে আমরা হাসিয়া উঠি । যাহা সুসংগত তাহা চিরদিনের নিয়মসম্মত, যাহা অসংগত তাহা ক্ষণকালের নিয়ম ভঙ্গ । যেখানে যাহা হওয়া উচিত সেখানে তাহা হইলে তাহাতে আমাদের মনের কোনো উত্তেজনা নাই, হঠাৎ না হইলে কিংবা আর-একরূপ হইলে সেই আকস্মিক অনতিপ্রবল উৎপীড়নে মনটা একটা বিশেষ চেতনা অনুভব করিয়া সুখ পায় এবং আমরা হাসিয়া উঠি । সেদিন আমরা এই পর্যন্ত গিয়াছিলাম— আর বেশি দূর যাই নাই। কিন্তু তাই বলিয়া আর যে যাওয়া যায় না। তাহা নহে । আরো বলিবার কথা আছে । শ্ৰীমতী দীপ্তি প্রশ্ন করিয়াছেন যে, আমাদের চার পণ্ডিতের সিদ্ধান্ত যদি সত্য হয় তবে চলিতে চলিতে হঠাৎ অল্প হঁচট খাইলে কিংবা রাস্তায় যাইতে অকস্মাৎ অল্পমাত্রায় দুৰ্গন্ধ নাকে আসিলে আমাদের হাসি পাওয়া, অন্তত, উত্তেজনাজনিত সুখ অনুভব করা উচিত । এ প্রশ্নের দ্বারা আমাদের মীমাংসা খণ্ডিত হইতেছে না, সীমাবদ্ধ হইতেছে মাত্র । ইহাতে কেবল এইটুকু দেখা যাইতেছে যে, পীড়নমাত্রেই কৌতুকজনক উত্তেজনা জন্মায় না ; অতএব, এক্ষণে দেখা আবশ্যক, কৌতুকপীড়নের বিশেষ উপকরণটা কী ? : জড়প্রকৃতির মধ্যে করুণরসও নাই, হাস্যরসও নাই। একটা বড়ো পাথর ছোটাে পাথরকে গুড়াইয়া ফেলিলেও আমাদের চোখে জল আসে না, এবং সমতল ক্ষেত্রের মধ্যে চলিতে চলিতে হঠাৎ একটা খাপছাড়া গিরিশৃঙ্গ দেখিতে পাইলে তাঁহাতে আমাদের হাসি পায় না। নদী-নিঝর পর্বত-সমুদ্রের মধ্যে মাঝে মাঝে আকস্মিক অসামঞ্জস্য দেখিতে পাওয়া যায়- তাহা বাধাজনক বিরক্তিজনক পীড়াজনক হইতে পারে, কিন্তু কোনো স্থানেই কৌতুকজনক হয় না । সচেতন পদার্থসম্বন্ধীয় খাপছাড়া ব্যাপার ব্যতীত শুদ্ধ জড়পদার্থে আমাদের হাসি আনিতে পারে না । কেন, তাহা ঠিক করিয়া বলা শক্ত, কিন্তু আলোচনা করিয়া দেখিতে দোষ নাই । আমাদের ভাষায় কৌতুক এবং কৌতুহল শব্দের অর্থের যোগ আছে। সংস্কৃত সাহিত্যে অনেক স্থলে একই অর্থে বিকল্পে উভয় শব্দেরই প্রয়োগ হইয়া থাকে । ইহা হইতে অনুমান করি, কৌতুহলবৃত্তির সহিত কৌতুকের বিশেষ সম্বন্ধ আছে। কৌতুহলের একটা প্রধান অঙ্গ নূতনত্বের লালসা, কৌতুকেরও একটা প্রধান উপাদান নূতনত্ব । অসংগতের মধ্যে যেমন নিছক বিশুদ্ধ নূতনত্ব আছে সংগীতের মধ্যে তেমন নাই। কিন্তু প্ৰকৃত অসংগতি ইচ্ছাশক্তির সহিত জড়িত, তাহা জড়পদার্থের মধ্যে নাই। আমি যদি পরিষ্কার পথে চলিতে চলিতে হঠাৎ দুৰ্গন্ধ পাই তবে আমি নিশ্চয় জানি, নিকটে কোথাও এক জায়গায় দুৰ্গন্ধ বস্তু আছে, তাই এইরূপ ঘটিল ; ইহাতে কোনোরূপ নিয়মের ব্যতিক্রম নাই, ইহা অবশ্যম্ভাবী। জড়প্রকৃতিতে যে কারণে যাহা হইতেছে তাহা ছাড়া আর-কিছু হইবার জো নাই, ইহা নিশ্চয় ।