পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S\) by রবীন্দ্র-রচনাবলী দৃশ্য ; সে তখন এই-সকল অমর-আত্মা-ধারী জীৰ্ণকলেবরগুলির প্রতি সহাস্য কটাক্ষপাত করিয়া বলিতে পারে, ঐ তো তোমাদের ষড়দর্শন, তোমাদের কালিদাসের কাব্য, তোমাদের তেত্ৰিশ কোটি দেবতা পড়িয়া আছে, নাই শুধু দুই মুষ্টি তুচ্ছ তণ্ডুলকণা, অমনি তোমাদের অমর আত্মা, তোমাদের জগদবিজয়ী মনুষ্যত্ব, একেবারে কণ্ঠের কাছটিতে আসিয়া ধুকধুক করিতেছে। স্থূল কথাটা এই যে, অসংগতির তার অল্পে অল্পে চড়াইতে চড়াইতে বিস্ময় ক্রমে হাস্যে এবং হাস্য ক্ৰমে অশ্রুজলে পরিণত হইতে থাকে । ফায়ুন ১৩০১ সৌন্দর্য সম্বন্ধে সন্তোষ দীপ্তি এবং স্রোতস্বিনী উপস্থিত ছিলেন না, কেবল আমরা চারিজন ছিলাম । সমীর বলিল— দেখো, সেদিনকার সেই কৌতুকহাস্যের প্রসঙ্গে আমার একটা কথা মনে উদয় হইয়াছে। অধিকাংশ কৌতুক আমাদের মনে একটা-কিছু অদ্ভুত ছবি আনয়ন করে এবং তাহাতেই আমাদের হাসি পায় । কিন্তু যাহারা স্বভাবতই ছবি দেখিতে পায় না, যাহাদের বুদ্ধি অ্যাবসট্র্যাক্ট বিষয়ের মধ্যে ভ্ৰমণ করিয়া থাকে, কৌতুক তাহাদিগকে সহসা বিচলিত করিতে পারে না । ক্ষিতি কহিল— প্রথমত তোমার কথাটা স্পষ্ট বুঝা গেল না, দ্বিতীয়ত অ্যাবসট্র্যাক্ট শব্দটা ইংরাজি । সমীর কহিল— প্ৰথম অপরাধটা খণ্ডন করিবার চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু দ্বিতীয় অপরাধ হইতে নিস্কৃতির উপায় দেখি না, অতএব সুধীগণকে ওটা নিজগুণে মার্জনা করিতে হইবে । আমি বলিতেছিলাম, যাহারা দ্রব্যটাকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়া তাহার গুণটাকে অনায়াসে গ্রহণ করিতে পারে তাহারা স্বভাবত হাস্যরসারসিক হয় না । ক্ষিতি মাথা নাডিয়া কহিল— উহু, এখনো পরিষ্কার হইল না । সমীর কহিল— একটা উদাহরণ দিই। প্রথমত দেখো, আমাদের সাহিত্যে কোনো সুন্দরীর বর্ণনাকালে ব্যক্তিবিশেষের ছবি আঁকিবার দিকে লক্ষ নাই ; সুমেরু দাড়িম্ব কদম্ব বিম্ব প্রভৃতি হইতে কতকগুলি গুণ বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া তাহারই তালিকা দেওয়া হয় এবং সুন্দরীমাত্রেরই প্রতি তাহার আরোপ হইয়া থাকে । আমরা ছবির মতো স্পষ্ট করিয়া কিছু দেখি না এবং ছবি আঁকি না— সেইজন্য কৌতুকের একটি প্রধান অঙ্গ হইতে আমরা বঞ্চিত । আমাদের প্রাচীন কাব্যে প্রশংসাচ্ছলে গজেন্দ্রগমনের সহিত সুন্দরীর মন্দগতির তুলনা হইয়া থাকে । এ তুলনাটি অন্যদেশীয় সাহিত্যে নিশ্চয়ই হাস্যকর বলিয়া গণ্য হইত। কিন্তু এমন একটা অদ্ভুত তুলনা আমাদের দেশে উদ্ভূত এবং সাধারণের মধ্যে প্রচলিত হইল কেন ? তাহার প্রধান কারণ, আমাদের দেশের লোকেরা দ্রব্য হইতে তাহার গুণটা অনায়াসে বিশ্লিষ্ট করিয়া লইতে পারে । ইচ্ছামত হাতি হইতে হাতির সমস্তটাই লোপ করিয়া দিয়া কেবলমাত্র তাহার মন্দগমনটুকু বাহির করিতে পারে, এইজন্য ষোড়শী সুন্দরীর প্রতি যখন গজেন্দ্ৰগমন আরোপ করে তখন সেই বৃহদাকার জন্তুটাকে একেবারেই দেখিতে পায় না । যখন একটা সুন্দর বস্তুর সৌন্দর্য বর্ণনা করা কবির উদ্দেশ্য হয় তখন সুন্দর উপমা নির্বাচন করা আবশ্যক, কারণ, উপমার কেবল সাদৃশ্য-অংশ নহে, অন্যান্য অংশও আমাদের মনে উদয় না হইয়া থাকিতে পারে না । সেইজন্য হাতির শুড়ের সহিত স্ত্রীলোকের হাত-পায়ের বর্ণনা করা সামান্য দুঃসাহসিকতা নহে। কিন্তু আমাদের দেশের পাঠক এ তুলনায় হাসিল না, বিরক্ত হইল না। তাহার কারণ, হাতির শুড় হইতে কেবল তাহার গোলত্বটুকু লইয়া আর-সমস্তই আমরা বাদ দিতে পারি, আমাদের সেই আশ্চর্য ক্ষমতাটি আছে । গৃধিনীর সহিত কনের কী সাদৃশ্য আছে বলিতে পারি না, আমার তদুপযুক্ত কল্পনাশক্তি নাই ; কিন্তু সুন্দর মুখের দুই পাশে দুই গৃধিনী বুলিতেছে মনে করিয়া হাসি পায় না কল্পনাশক্তির এত অসাড়তাও আমার নাই। বোধ করি ইংরাজি পড়িয়া আমাদের না-হাসিবার স্বাভাবিক ক্ষমতা বিকৃত হইয়া যাওয়াতেই এরূপ দুর্ঘটনা ঘটে ।