পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত S8S সেইজন্য আমরা বলি গুরুদেব আমাদের পূজনীয়, এ কথা বলি না যে যিনি পূজনীয় তিনি আমাদের . গুরু। হয়তো গুরু আমার কানে যে মন্ত্ৰ দিয়াছেন তাহার অর্থ তিনি কিছুই বুঝেন না, হয়তো গুরুঠাকুর আমার মিথ্যা মোকদ্দমায় প্রধান মিথ্যাসাক্ষী, তথাপি তাহার পদধূলি আমার শিরোধার্য-- এরূপ মত গ্রহণ করিলে ভক্তির জন্য ভক্তিভাজনকে খুঁজিতে হয় না, দিব্য আরামে ভক্তি করা যায় । সমীর কহিল- ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে আমাদের মধ্যে ইহার ব্যতিক্রম ঘটিতেছে । বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্র তাহার একটি উদাহরণ। বঙ্কিম কৃষ্ণকে পূজা করিবার এবং কৃষ্ণপূজা প্রচার করিবার পূর্বে কৃষ্ণকে নির্মল এবং সুন্দর করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়াছেন। এমন-কি, কৃষ্ণের চরিত্রে অনৈসৰ্গিক যাহা-কিছু ছিল তাহাও তিনি বর্জন করিয়াছেন । তিনি কৃষ্ণকে র্তাহার নিজের উচ্চতম আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন । তিনি এ কথা বলেন নাই যে, দেবতার কোনো কিছুতেই দোষ নাই, তেজীয়ানের পক্ষে সমস্ত মার্জনীয়। তিনি এক নূতন অসন্তোষের সূত্রপাত করিয়াছেন ; তিনি পূজা-বিতরণের পূর্বে প্রাণপণ চেষ্টায় দেবতাকে অন্বেষণ করিয়াছেন ও হাতের কাছে যাহাকে পাইয়াছেন তাহাকেই নমোনমঃ করিয়া সস্তুষ্ট হন নাই । ক্ষিতি কহিল— এই অসন্তোষটি না থাকাতে বহুকাল হইতে আমাদের সমাজে দেবতাকে দেবতা হইবার, পূজ্যকে উন্নত হইবার, মূর্তিকে ভাবের অনুরূপ হইবার প্রয়োজন হয় নাই । ব্ৰাহ্মণকে দেবতা বলিয়া জানি, সেইজন্য বিনা চেষ্টায় তিনি পূজা প্ৰাপ্ত হন, এবং আমাদেরও ভক্তিবৃত্তি অতি অনায়াসে চরিতার্থ হয়। স্বামীকে দেবতা বলিলে স্ত্রীর ভক্তি পাইবার জন্য স্বামীর কিছুমাত্র যোগ্যতালাভের আবশ্যক হয় না, এবং স্ত্রীকেও যথার্থ ভক্তির যোগ্য স্বামী -অভাবে অসন্তোষ অনুভব করিতে হয় না । ভক্তিভাজনের প্রয়োজন নাই, এরূপ পরমসন্তোষের অবস্থাকে আমি সুবিধা মনে করি না । ইহাতে কেবল সমাজের দীনতা, শ্ৰীহীনতা এবং অবনতি ঘটিতে থাকে । বহির্জগৎটাকে উত্তরোত্তর বিলুপ্ত করিয়া দিয়া মনোজগৎকেই সর্বপ্রাধান্য দিতে গেলে যে ডালে বসিয়া আছি সেই ডালকেই কুঠারাঘাত করা হয় । ANAK S \Soo ) ভদ্রতার আদর্শ স্রোতস্বিনী কহিল— দেখো, বাড়িতে ক্রিয়াকর্ম আছে, তোমরা ব্যোমকে একটু ভদ্রবেশ পরিয়া আসিতে বলিয়ো । শুনিয়া আমরা সকলে হাসিতে লাগিলাম। দীপ্তি একটু রাগ করিয়া বলিল— না, হাসিবার কথা নয় ; তোমরা ব্যোমকে সাবধান করিয়া দাও না বলিয়া সে ভদ্রসমাজে এমন উন্মাদের মতো সাজ করিয়া আসে । এ-সকল বিষয়ে একটু সামাজিক শাসন থাকা দরকার । সমীর কথাটাকে ফলাইয়া তুলিবার অভিপ্ৰায়ে জিজ্ঞাসা করিল— কেন দরকার ? দীপ্তি কহিল— কাব্যরাজ্যে কবির শাসন যেমন কঠিন- কবি যেমন ছন্দের কোনো শৈথিল্য, মিলের কোনো ত্রুটি, শব্দের কোনো রূঢ়তা মার্জনা করিতে চাহে না- আমাদের আচারব্যবহার বসনভূষণ সম্বন্ধে সমাজ-পুরুষের শাসন তেমনি কঠিন হওয়া উচিত, নতুবা সমগ্র সমাজের ছন্দ এবং সৌন্দৰ্য্য কখনোই রক্ষা হইতে পারে না । ক্ষিতি কহিল— ব্যোম বেচারা যদি মানুষ না হইয়া শব্দ হইত। তাহা হইলে এ কথা নিশ্চয় বলিতে পারি, ভট্টিকাব্যেও তাহার স্থান হইত না ; নিঃসন্দেহ তাহাকে মুগ্ধবোধের সূত্র অবলম্বন করিয়া বাস করিতে হইত । আমি কহিলাম— সমাজকে সুন্দর সুশিষ্ট সুশৃঙ্খল করিয়া তোলা আমাদের সকলেরই কর্তব্য সে